255767

আজিজ মোহাম্মদ ভাই: এক রহস্য পুরুষের অজানা গল্প

গ’ডফাদার- বুৎপত্তিগত অর্থ খুঁজলে শব্দটি পবিত্র। কিন্তু প্রচলিত ব্যবহারে স;ন্ত্রাসবাদ কিংবা আন্ডারওয়ার্ল্ডের নেতাকে বলা হয় গ’ডফাদার। গ্ল্যামার, সৌন্দর্য্য, যৌ;নতা, ক্ষমতা ও ব্যবসার খাতিরে চলচ্চিত্র জগতে আনাগোনা থাকে গ’ডফাদারদের- এ তথা অজানা নেই কারো। বাংলাদেশেও শোনা যায় এমনই এক গ’ডফাদারের নাম। তিনি আজিজ মোহাম্মদ ভাই, যাকে ঘিরে আছে রহস্যময়তা। তবে সত্যিই কি তিনি গ’ডফাদার ছিলেন? চলচ্চিত্রে উত্থান-পতন, প্রেম- বিরহ, প্রতিহিংসা- প্রতিশোধ, ন্যায়- অন্যায়, বিদ্রোহ- খুন, কুচক্র- ষড়যন্ত্র দেখেই অভ্যস্ত দর্শক। না হলে বৃথা যায় ‘সিনেমাটিক অ্যাপ্রোচ’। তবে রূপালী পর্দার পিছনের কাহিনীও কম রংদার নয়। চটকদার এ রঙের দুনিয়ার সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সখ্যতা উহ্য করার মত নয়। কালো টাকা সাদা করতে, ক্ষমতার চর্চা, প্রতিপত্তি প্রচার কিংবা ব্যক্তি স্বার্থে চলচ্চিত্র জগতের আশেপাশেই থাকেন আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন কিংবা তথাকথিত গ’ডফাদার। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এমন একজন মানুষকে ঘিরেই রয়েছে বহুল প্রচলিত মিথ।

আজিজ মোহাম্মদ ভাই আজও বিদ্ধ আছেন অসংখ্য প্রশ্ন, বিস্ময় এবং কৌতুহলে। রহস্যের আড়ালের এই ব্যক্তির খোঁজ বরাবরই গিয়ে শেষ হয়েছে কোন না কোন কানাগলিতে। বেশ কয়েক বছর আগে আজিজ মোহাম্মাদ ভাইয়ের প্রসঙ্গে কথা হয় প্রয়াত বিনোদন সাংবাদিক সৈয়দ আওলাদ হোসেনের সঙ্গে। একটা সময় আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেছেন তিনি। ২০১৪’র শেষের দিকেও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন এই সংবাদকর্মী। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্যাংককে অবস্থান করছেন রহস্যময় ব্যক্তিত্ব আজিজ মোহাম্মদ ভাই। চলচ্চিত্র জগতের গুটিকয় মানুষ এবং সৈয়দ আওলাদের সঙ্গে সেখানেই দেখা করেন। বাংলাদেশ থেকে অভ্যাগতদের সম্মানে দুই রাত ডিনারের আয়োজনও করেছেন। সৈয়দ আওলাদ হোসেন এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আজিজ মোহাম্মদ ভাই সম্পর্কিত বেশ কিছু অজানা তথ্য। ‘ভাই’ মূলত আজিজ মোহাম্মদের পারিবারিক পদবী। আর এই পদবীর জন্যই অনেকে তাকে গ’ডফাদার মনে করে থাকেন। কারণ আর কিছু নয়, সাধারণত গ’ডফাদারদের ভাই বা দাদা নামে ডাকা হয়। তার বাবার নাম মোহাম্মদ ভাই। এই ভাই পদবীতেই মূলত রহস্যের শুরু। শুধু পুরুষ নয়, নারী সদস্যরাও ব্যবহার করেন এই পদবী। এমনকি তার স্ত্রীর নাম নওরিন মোহাম্মদ ভাই!

আজিজ মোহাম্মদ ভাই মূলত একজন ধনাট্য ব্যবসায়ী। প্রায় ১১টি ইন্ডাস্ট্রির মালিক তিনি। অলিম্পিক ব্যাটারী, অলিম্পিক বলপেন, এমবি ফার্মাসিটিউক্যাল, এমবি ফিল্ম, টিপ বিস্কুট, এনার্জি বিস্কুট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তিনি। এছাড়া মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরে রয়েছে তার উঁচু মানের রিসোর্ট। চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকেই মূলত তার এই জগতে আসা। অনেক আগে থেকেই তিনি বেনামে অর্থ লগ্নি করতেন চলচ্চিত্রে। ‘আমি সেই মেয়ে’, ‘আমার প্রতিজ্ঞা’, ‘ভয়ঙ্কর পরিনাম’, ‘মায়ের জিহাদ’, ‘শেষ বংশধর’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র তার অর্থায়নে নির্মিত। প্রায় ৫০টি সফল চলচ্চিত্র বেনামে প্রযোজনা করেছেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই।

শুধু চলচ্চিত্র নয়, বিজ্ঞাপনেও তিনি পরিবর্তন আনেন। মিতা নূরের ‘আলো আলো বেশি আলো’ বিজ্ঞাপনটি মনে আছে? অলিম্পিক ব্যাটারীর এ বিজ্ঞাপনটি সময়ের সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে গন্য করা হয়। তবে তিনি গ’ডফাদার হিসেবে পরিচিত পেলেন কি করে? আর কি করে তৈরি হল তাকে ঘিরে রংদার রহস্যের জাল? আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের কাছের একজন নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি মর্নিং সানের সম্পাদকের মেয়েকে বিয়ে করেই তিনি সাংবাদিকদের চক্ষুশূলে পরিণিত হন। এরপর সাংবাদিকরাই তাকে মিডিয়া ডনে পরিণত করে। তাকে মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত করে তোলে।

তবে, শোনা যায় পত্র পত্রিকায় তাকে নিয়ে যখন রং চড়িয়ে অনেককিছু লেখা হতো কিংবা গ’ডফাদার নামে ডাকা হতো- বিষয়গুলো উপভোগ করতেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। বলতেন, ‘এতো লোকের মাঝে আমাকেই গ’ডফাদার বলা হয়, তাই বা কম কিসে!’ পুরোনো ঢাকার আরমানিটোলায় আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের জন্ম। পড়াশুনা করেছেন সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে। পাঁচ সন্তানের জনক তিনি, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। ঢাকার এমবি ফার্মটি দেখাশোনা করতেন তার স্ত্রী নওরিন। এখন পুরো পরিবারই ব্যংকক থাকেন।

ব্যক্তিজীবনে তিনি খুব সৌখিন লোক। হৈ হুল্লোড় ও আনন্দ উল্লাসে থাকতে পছন্দ করেন। নিজেকে প্রচারের মধ্যেও রাখতে তিনি ভালোবাসেন। ঘরের বিভিন্ন প্লেট মগে তার নাম রয়েছে। এগুলো তিনি ছাপিয়ে নেন। জিনিসপত্র সংগ্রহও তার নেশা। মার্সিডিজ বেঞ্জসহ প্রায় ৬০ টি গাড়ি আছে তার। জানা যায়, চলচ্চিত্র জগতের লোকজন পেলে খুশি হন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। আর তার অতিথি সেবা প্রবাদতুল্য। সবাইকে নিজে খাওয়াতে পছন্দ করেন, নিজে লিফট খুলে দেন। এগুলোই তার বন্ধুবৎসল স্বভাবের বৈশিষ্ট্য।

তবুও থেকে যায় কিছু প্রশ্ন। একেবারে স্বচ্ছ কিংবা সৎ থেকে এতোগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালানো যায় কি? অবশ্য যে সকল কারণে বিতর্কিত ছিলেন, তার বেশিরভাগই চলচ্চিত্র জগত সংশ্লিষ্ট। চলচ্চিত্র ব্যবসায় পুঁজি জোগাতেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। তবুও সালমান শাহর মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী করা হয় তাকে। যদিও বিখ্যাত এই নায়কের আকস্মিক মৃত্যুর সময়ে ব্যংককে ছিলেন ‘গ’ডফাদার’। আর নায়ক সোহেল চৌধুরী হ’ত্যা মামলায় জড়িত অভিযোগে গ্রেফতারও হয়েছিলেন তিনি। তবে কি তার ‘গ’ডফাদার’ উপমা শুধুই মিডিয়ার সৃষ্টি? রহস্যের বেড়াজালে আবৃত আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের মিথ কিংবা প্রচলিত কথার সত্যতা যাচাই সম্পর্কিত প্রশ্ন আবারও শেষ হয় কানাগলিতে।

সূত্রঃ দেশ রুপান্তর

পাঠকের মতামত

Comments are closed.