260862

জিপিএস ট্র্যাকার বসানো হলো তিলিহাঁসের পিঠে!

ডেস্ক রিপোর্ট : শত শত অতিথি পাখির কিচিরমিচিরে এখন মুখরিত শান্ত পদ্মার বুকে জেগে ওঠা চর। তিব্বতীয় মানিকচক, সাইবেরিয়ান ফিদ্দাসহ অসংখ্য পাখির দেখা মিলছে রাজশাহীর পদ্মাচরে।

নদীর পাড়ে পানি নিয়ে খেলা, খাবারের সন্ধান, খুনসুটি আর বিশ্রাম শেষে হঠাৎ করে পাখিদের উড়ে চলার দৃশ্য যেন জলরঙে আঁকা ছবি। নৈসর্গিক এ দৃশ্য খুব সহজে আকৃষ্ট করছে সাধারণ দর্শনার্থী এবং পাখিপ্রেমীদের।

রোববার রাজশাহীর পদ্মাচরে জলচর পাখির শুমারি করেছে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)। সংগঠনের বাংলাদেশের ওয়াইল্ড বার্ড মনিটরিং প্রোগ্রামের আওতায় করা এই শুমারিতে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, রাজশাহী বার্ড ক্লাব এবং বন অধিদফতর। শুমারিকালে পরিযায়ী তিলিহাঁসের পিঠে বসানো হয়েছে অবস্থান নির্ণায়ক যন্ত্র (জিপিএস ট্র্যাকার)। রাজশাহীতে এই প্রথম কোনো পাখির পিঠে জিপিএস ট্র্যাকার বসানো হলো। আইইউসিএনের পক্ষ থেকে যন্ত্রটি পাখির গায়ে স্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে পাখিটির অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবেন গবেষকরা। তার চলাচলের পথ ও আচরণ সম্পর্কেও তথ্য জানা যাবে।

পাখি গবেষক সারোয়ার আলম জানান, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তিলিহাঁসটির ওজন ৩১০ গ্রাম। এটি সবচেয়ে দূর পরিযায়ী হাঁস। পাখির গতিবিধি লক্ষ করার জন্য এটি বিশ^ব্যাপী একটি পরিচিত ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। ট্যাগের ওজন প্রায় ১০ গ্রাম, যা পাখির শরীরের ওজনের মাত্র ৩ শতাংশ। ফলে এর স্বাভাবিক চলাফেরায় কোনো সমস্যা হবে না।

সারোয়ার আলম জানান, পাখিরা কোন দেশে, কত দূর যায়, নদীতে থাকে, না সমুদ্রে চলে যায় এই যন্ত্র স্থাপনের আগে সুনির্দিষ্টভাবে তা জানা যেত না। এক জায়গায় থাকলেও পাখিরা খাবারের জন্য পাশের অনেক জায়গায় যায়। পাখিদের সুরক্ষার জন্য আমাদের ওই জায়গাগুলোতেও নজর রাখা দরকার। এ থেকে কোথাও আক্রান্ত পাখির ভাইরাস ছড়ানোর গতিবিধি নির্ণয় করা যায়। যদি পৃথিবীর কোনো জলাশয়ে বার্ড ফ্লুর সংক্রমণ দেখা দেয়, তাহলে ওই যন্ত্রের মাধ্যমে তাও জানা যাবে, পাখিটি সেখানে রয়েছে কি না, সেখান থেকে সে বাংলাদেশে আসছে কি না।

রাজশাহীর পদ্মা নদীর প্রায় ৩৯ কিলোমিটার অংশে পাখিশুমারি করা হয়। চরখানপুর, খিদিরপুর, দশ নম্বর চর, চারঘাট অংশ ও মধ্যচরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পাখি পাওয়া গেছে। পদ্মাচরে পাওয়া গেছে ৩৭ প্রজাতির ৪ হাজার ২৫টি পাখি। এর মধ্যে ২৭ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি মিলেছে। সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১শটি পাওয়া গেছে পিয়ং হাঁস। সৈকত পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে টেমিংয়ের চাপাখি। সবচেয়ে বিরল পাখির মধ্যে দেখা গেছে বৈকাল তিলিহাঁস।

এছাড়া দেশি মেটে হাঁস, লালমাথা ভূতিহাঁস, ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, কালা মানিকজোড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, পদ্মার চরে অনেক দুর্লভ প্রজাতির পাখি পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে এ বছরই পদ্মাচরে প্রথম দেখা গেছে পাতি মার্গেঞ্জার। বাংলাদেশে এই পরিযায়ী পাখি অনিয়মিত। সাম্প্রতিককালে এটিকে তৃতীয়বারের মতো দেখা গেল। এর আগে দু’বার ঠাকুরগাঁওয়ে দেখা গেছে।

পদ্মার চরে পাওয়া গেছে ধলালেজ শিলাফিদ্দাও। পাখিটি দেখার জন্য সাতবার বাংলাদেশে আসেন যুক্তরাজ্যের পাখিবিজ্ঞানী ফিলিপ রাউন্ড। সপ্তমবার তিনি পাখিটি পান রাজশাহীর পদ্মার চরে। গবেষণায় ধরা পড়েছে, বিলুপ্তপ্রায় পাখিটি ২০ বছর ধরে এই চরেই বাস করছে। পদ্মার চরে রয়েছে দাগি রাজহাঁস, রাঙা মানিকজোড়, গুলিন্দা, সরালি, বেনেবৌ, রাজমণি হাঁস, মেটে জিরিয়া, ডোরা গলা রাজহাঁস, রাঙা মানিকজোড়, কালাগলা মানিকজোড়, ধলাগলা মানিকজোড়, উল্টোঠুঁটি, শতদাগি ঘাসপাখি, লেঞ্জা, বালি ও চখাহাঁসসহ নানা পাখি। তবে প্রথমবারের মতো হওয়া পদ্মার পাখিশুমারিতে ধরা পড়েছে ৩৭টি প্রজাতি। টেলিস্কোপের সাহায্যে এই পাখিশুমারি করা হয়।

আইইউসিএনের বাংলাদেশের মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপু জানান, আমরা সাধারণত হাওরাঞ্চলে পাখির শুমারি করি। তবে এই মৌসুমে রাজশাহী থেকে প্রথম শুমারি করা হলো। রাজশাহীতে পাখিরা অনেক ভালো অবস্থানে আছে। এর কারণ, পদ্মায় বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। জায়গা অনেক বেশি হওয়ার কারণে পাখিরা এখানে আশ্রয় নেয়। এক চরে অনুকূল পরিবেশ না পেলে তারা আরেক চরে উড়ে যায়। তিনি জানান, প্রতিবছর ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী পাখির তথ্য প্রকাশ করে থাকে। পাখিশুমারিতে পদ্মার চরে পাওয়া তথ্যও ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশনালে পাঠানো হবে।

রাজশাহী বার্ড ক্লাবের সদস্য নূর-এ-সাউদ জানান, পাখিদের নিরাপদ বিচরণের জন্য আমরা পদ্মার চরকে অভয়াশ্রম ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছি। এটি হলে চরে আরও বেশি পাখি আসবে। আর ইদানীং চরে বিষটোপ দিয়ে পাখি মেরে ফেলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি বন্ধ করার জন্য আমরা প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশা করি।

জেলা প্রশাসক হামিদুল হক জানান, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি ব্যবস্থাপনা বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সূত্র : আমাদের সময়.কম

পাঠকের মতামত

Comments are closed.