260923

৯০ বছরেও স্কুলে হাজির দাদি, দরিদ্রতা কেড়েছে শিক্ষার সুযোগ

ডেস্ক রিপোর্ট : অভাবের সংসারে ছিল না কাপড় কেনার মতো টাকা। সেখানে বই ও খাতা কিনবেন কীভাবে! তবে মাঝে মাঝেই তিনি স্কুলে যেতেন। তার বাবা ছিলেন একজন শ্রমিক।

মাত্র ১০ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় অনুসূয়ার। এরপর আর পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি তিনি। শুধু নিজের নাম লিখতে পারতেন, অক্ষর চিনতেন ও ২১ পর্যন্ত গুনতে পারতেন।

বর্তমানে অনসূয়া দেশমুখের বয়স ৯০ বছর। ছোটবেলায় তার যে স্বপ্নটি অধরা ছিল সেটিই এখন পূরণের পথে। এই বয়সেও নিয়ম করে স্কুলে যাচ্ছেন তিনি। পড়ালেখা শিখছেন। শুধু অনুসূয়া নন, তার মতো অনেক নারীই স্কুলে যাচ্ছেন নিয়মিত। অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই?

যে বয়সে শরীর সাঁই দেয় না সামান্য পথ হাঁটার, সেই বয়সেই কি-না পড়ালেখা করছেন তারা। এদের কারো বয়স ৬০, আবার কারো বা ৯০। বলছি, মহারাষ্ট্রের থানে জেলার ফাঙ্গান গ্রামের একটি বয়ষ্ক স্কুলের কথা। যেখানে বিকেল হলেই দল বেঁধে প্রবীণরা জড়ো হন পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে। ‘আজিবাইঞ্চি শালা’ নামের এই স্কুলটির মোট শিক্ষার্থী ২৯ জন নারী।

‘প্রথমদিকে আমি লজ্জা বোধ করতাম। শিশুরা স্কুলে যায়, কিন্তু বৃদ্ধরা স্কুলে গিয়ে কি শিখবে? এই ভাবনায় স্কুলে আসার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কথাগুলো বলছিলেন ৬৫ বছর বয়সী কান্তা মোরে। তিনি বলেন, যখন আমি জানতে পারলাম আমার মতো অনেক বৃদ্ধারা পাঠশালায় যোগ দিচ্ছেন, তখন আমিও স্কুলে এসে পড়ালেখা শিখতে শুরু করি।

এখন আমি পড়তে এবং লিখতে পারি। শিক্ষার গুরুত্ব এখন আমি বুঝতে পেরেছি। আত্ম-সম্মানকে আরো বাড়িয়ে দেয় শিক্ষা। আগে ব্যাংকের নথিপত্রে আঙুলের ছাপ দিলেও এখন আমি সেগুলোতে নিজেই স্বাক্ষর করতে পারি।

জীবনের শেষ বয়সে স্লেট, ব্যাগ কাঁধে শিক্ষার জন্যই এ পথ চলা। গোলাপী রঙের শাড়ি পরে দল বেঁধে প্রবীণদের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য যেন অনবদ্য। এই গ্রামের দাদি-নানিরা প্রতিদিন বিকেলেই দল বেঁধে বাড়ি থেকে বের হন। তারা পড়াশোনা করছেন। বয়স তাদের কাছে কোনো বিষয়ই না। মহারাষ্ট্রের নারীরা শিক্ষার সুযোগ খুব একটা পান না। পুরুষের থেকে এক-তৃতীয়াংশ কম নারী এখানে লিখতে বা পড়তে পারেন।

এই বয়স্ক নারীরা কেউই ঠিকমতো একটা অক্ষর চোখে দেখতে পারেন না, তাতে কি? নিয়ম করে কিন্তু স্কুলে আসতে ভুলেন না তারা। আবার কারো বুকে ব্যথা শুরু হয়ে যায় কথা বলতে বলতেই। বৃহস্পতিবার ছাড়া প্রতিদিনই তারা স্কুলে যান, ক্লাস করেন। এ বছরের নারী দিবসে স্কুলটির এক বছর পূর্ণ হয়েছে।
কেউ আসেন একা আবার কেউ আসেন নাতি-নাতনির হাত ধরে। তারা বলেন, স্কুল আমাদের খুব ভালো লাগে। স্কুলব্যাগগুলো হাতে নিয়ে সব দাদি-নানিরা একসঙ্গে স্কুলে যান। তারা বলেন, আমরা খুব গর্বিত। শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ কাজে লাগাতে পারছি।

এ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ৪১ বছর বয়সী ইয়োগেন্দ্রা বাংগাড়ি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নারী দিবসে তাদেরকে সম্মান জানানোর কথা বলা হয়। তাই আমি ভাবলাম আমাদের দাদি-নানিদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া উচিত। তাদের সময়ের নারীরা স্কুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ পাননি। আমার তাদের জন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিল। বিষয়টা নিয়ে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে আলাপ করলাম। তারা এ উদ্যোগে আমাকে সমর্থন জোগালেন।
ইয়োগেন্দ্রা বাংগাড়ি জানিয়েছেন, নারীদের শাড়ি ও শিক্ষার উপকরণ কেনার জন্য তিনি গ্রামের সবার কাছ থেকে অনুদান নিয়েছেন। তাদের সহযোগিতায় একটি শ্রেণিকক্ষও তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, যদি কোনো নারী শিক্ষিত হন তবে তার সন্তানেরাও শিক্ষিত হয়। তার ঘর তিনি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে রাখেন।

আরেক প্রবীণ নারী বলেন, আমাদের কাছে বই আছে কিন্তু তা আমরা পড়তে পারি না। কারণ বয়সের জন্য আমাদের চোখের জ্যোতি কমে গেছে। মৃত্যুর পর যখন সৃষ্টিকর্তা আমাদের কাছে জানতে চাইবেন, তুমি তোমার জীবনে কী করেছ? ভেবে ভালো লাগছে যে আমি অন্তত বলতে পারব, আমি আমার নাম স্বাক্ষর করা শিখেছি।আমার স্কুলে আসতে ভালো লাগে। শুধু ক্লাসের পড়াশোনাতেই সীমাবদ্ধ নয় স্কুলের কার্যক্রম। এখানে পড়তে আসা সবাই একটি করে গাছ লাগান স্কুলের মাঠে। সেটির যত্নও তারাই করেন। গাছটির নাম দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর নামেই। গাছের পাশেই লেখা থাকে সেই নাম।

গ্রামের এক ফসলি জমির পাশে গাছতলায় বাঁশ দিয়ে বানানো এই স্কুল। একটি মাত্র ব্ল্যাকবোর্ড। মেঝেতেই পাটি পেতে বসার ব্যবস্থা। স্কুলে ৩০ বছর বয়সী শিক্ষক শীতল মোরে বিনা পারিশ্রমিকে এখানে শিক্ষকতা করেন। এখানে শিক্ষার্থীদের একজন তার শাশুড়ি।
গত এক বছরে স্কুলের একজন শিক্ষার্থী মারা গেছেন। আর তিনজন নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিন স্কুলে উপস্থিতির সংখ্যা ২৫ থেকে ২৮ জন। যাদের বয়স ৬০ থেকে ৯০ বছর। যখন এসব নারী এই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন তখন তাদের কারোই অক্ষরজ্ঞান ছিল না।

শিক্ষক শীতল মোরে বলেন, ভারতের বয়স্ক নারীরা হাতের আঙুলের ছাপ ছেড়ে সই করার যোগ্যতা অর্জন করছেন, লিখতে পড়তে শিখছেন এটা অনেক বড় উদ্যোগ। সব গ্রামেই এমন স্কুল থাকা প্রয়োজন।

সূত্র: ইন্ডিয়ানএক্সপ্রেস

পাঠকের মতামত

Comments are closed.