261592

বিপুল ভোটে নৌকার জয়

ডেস্ক রিপোর্ট : গত কয়েকটি নির্বাচনে ভোটারদের অনাগ্রহের প্রেক্ষাপটে এবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের বড় বিজ্ঞাপন ছিল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)।

অনেক বিতর্কের মধ্যেও ইভিএমের প্রতি আগ্রহী হয়ে ভোটাররা কেন্দ্রে আসবে বলে আশায় ছিল ইসি; কিন্তু সেই আশার গুঁড়েও পড়েছে বালি।ভোটার নিয়ে দিনভর হা-পিত্যেসের মধ্যে রাজধানীজুড়ে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের দুই মেয়র প্রার্থীই বড় ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন।

ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস জয়ী হয়েছেন পৌনে ২ লাখ ভোটের ব্যবধানে; তিনি পেয়েছেন ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট, তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ইশরাক হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫১২ ভোট।

ঢাকা উত্তরেও পৌনে ২ লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম; নৌকায় তার ৪ লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোটের বিপরীতে বিএনপির তাবিথ আউয়াল ধানের শীষে পেয়েছেন ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৬১ ভোট।

দক্ষিণে মোট ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ভোটারের মধ্যে মাত্র ২৯ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। উত্তরে ভোটের হার আরও কম ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ।উত্তর ও দক্ষিণ মিলিয়ে ২৪শ‘র বেশি কেন্দ্রের বাইরে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীদের সরব উপস্থিতির মধ্যে কেন্দ্রের ভেতরে ভোটারের জন্য হাহাকার।ভাষানটেক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শনিবার বেলা ১০টা ৪৭ মিনিটের দৃশ্য। এটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের একটি কেন্দ্র।

২০১৪ সালে অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের হার কমতে থাকে, যাকে গণতন্ত্রের জন্য ‘অশনি সঙ্কেত’ মনে করছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মতো অনেকে।

পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটিতে একদিনেই ভোট হয়েছিল। তাতে ব্যালট পেপারে গড়ে ভোট পড়েছিল ৪৩%।সেবার ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৩৭ শতাংশ; দক্ষিণ সিটিতে ৪৮ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদের উপ নির্বাচনে ৩১ শতাংশ ভোট পড়ে।

কে এম নূরুল হুদা কমিশন যোগ দেওয়ার দুই বছরের মাথায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৪০ শতাংশ, তা নিয়েও রয়েছে অনেক অভিযোগ।সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম-৮ আসনে উপনির্বাচনে মাত্র ২২ শতাংশ ভোটগ্রহণ ইসির মাথায় চিন্তার ভাঁজ ফেললেও তাদের জন্য উৎসাহের উপলক্ষ ছিল তার আগে বিভিন্ন পৌরসভায় ইভিএমে ৮০ শতাংশের উপরে ভোটের হার।

কিন্তু ভোটের হারে ঘটেনি উন্নতি; যদিও সিইসি কে এম নূরুল হুদার ভাষ্যে, তাদের তৎপরতার কোনো ঘাটতি ছিল না।সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “সেটা প্রার্থী, যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাদের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। আমরা পরিবেশ সৃষ্টি করেছি। আমাদের দিক থেকে প্রস্তুতির কোনো কমতি নেই।”

ভোট দিতে গিয়ে ভোটার উপস্থিতি কম দেখে কর্মসংস্থান ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুর রউফ বলেন, “এমন পরিবেশেও ভোটাররা কেন যে ভোট দিতে আসল না, বুঝলাম না। এটা এক ধরনের রাজনৈতিক পরাজয়।”

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে শনিবার গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোটারশূন্য একটি বুথ। ক্ষমতাসীন দলের আবার ভোটার কম উপস্থিতির জন্য নানা কারণ দেখিয়েছেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিক আমির হোসেন আমু দায়ী করেছেন যান চলাচল বন্ধ করাকে; যদিও বরাবরই তা করা হয়ে থাকে।

উত্তরে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম আবার ছুটিকে কারণ দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ছুটির কারণে অনেকে ঢাকার বাইরে চলে গেছেন বলে ভোট দিতে পারেননি।

অন্যদিকে বিএনপি বলছে, তাদের ভোটারদের কেন্দ্রে যেতেই দেওয়া হয়নি, বিভিন্নভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে, দেখানো হয়েছে ভয়-ভীতি। সিপিবিও বলেছে, ক্ষমতাসীনরা ভীতির সঞ্চার করেছে বলে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারেননি।তবে ভোট পর্যবেক্ষণ সংস্থা জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর মতে, এবার ইভিএমে জাল ভোটের সুযোগ না থাকা ভোটের হারে প্রভাব ফেলেছে।তিনি বলেন, “যারা ভোট দেওয়ার তারা দিয়েছে। জালিয়াতি বা কারচুপির সুযোগ এখানে ছিল না। জাল ভোট না থাকায় উপস্থিতি কমে গেছে।”

ইভিএমে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া নিয়ে ‘বিচলিত’ হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন জানিপপ চেয়ারম্যান।আর শেষ বিচারে ইসিও তা নিয়ে বিচলিত নয়। নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলছেন, “ভোটের হার বিষয় নয়। এক্ষেত্রে ভোটের প্রক্রিয়া যদি প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে তবেই তা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।”বড় ধরনের গোলযোগের ঘটনা না ঘটলেও ভোটকেন্দ্রগুলোতে আগের নির্বাচনগুলোর মতোই বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট দেখা যায়নি; কেন্দ্রের বাইরেও দেখা যায়নি তাদের তৎপরতা।

ভোটকেন্দ্রের বাইরে তৎপর পুলিশ; তবে বিএনপির অভিযোগ, তাদের সমর্থকদের কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়েছে বাধা।বিএনপি অভিযোগ করেছে, ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের এজেন্ট ও সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও বলেছেন, তিনি ভোটকেন্দ্র ঘুরে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট খুঁজে পাননি।এর কারণ কী- সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি ‘জানেন না’ বলে সেই উত্তর সাংবাদিকদেরই খুঁজে দেখার পরামর্শ দেন।

তবে বাধার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিএনপি হার অনুমান করতে পেরে ভোট কেন্দ্রে যায়নি।

আমির হোসেন আমুর ভাষ্যে, “তারাই বলেছিল, ভোটের দিন পর্যন্ত তারা সবকিছু দেখবে, তারা ভোট কেন্দ্র পাহারা দেবে। কিন্তু আজকে তাদের দেখা যায়নি। ভরাডুবি বুঝতে পেরেই তাদের সপক্ষে কিছু যুক্তি ধারণের জন্যই আজকে তারা ভোটকেন্দ্রে অনুপস্থিত ছিল।”

সিইসি নূরুল হুদাও দাবি করেছেন, কোনো ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট না দিয়ে ফিরে যাননি। ইভিএমে ‘ভালো ভোট হয়েছে’। তবে ইভিএম নিয়েও বিড়ম্বনা কম ছিল না এবং খোদ সিইসিকেও সেই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। আঙুলের ছাপ মেলেনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা কামাল হোসেনেরও।

প্রবীণ অনেক ভোটারের আঙুলের ছাপ মিলছিল না বলে তাদের ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ দেরি হয়েছে। আবার গোপন কক্ষে ইভিএমে নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য হওয়ার বেশ কয়েকটি অভিযোগ পাওয়া গেছে।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অনেকেরই আঙুলের ছাপ নেয়নি ইভিএম।

ইভিএমে দ্রুত ফল ঘোষণার কথা ইসি এতদিন ধরে বলে এলেও ঢাকা দক্ষিণের ফল ঘোষণা করতে মধ্যরাত গড়িয়ে যায়, উত্তরের ক্ষেত্রে সময় লাগে আরও বেশি। অর্থাৎ কাগুজে ব্যালটের মতোই সময় লেগে যায় ইভিএম ভোটের ফল ঘোষণায়।

দেরির কারণ নিয়ে দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন বলেন, “প্রিজাইডিং অফিসাররা ট্যাবে রেজাল্ট পাঠাতে ভুল করেছেন, অনেকে ম্যানুয়ালি পাঠিয়েছেন।”

ইভিএমর ত্রুটি তুলে ধরতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “ভোটার উপস্থিতি না হলেও সরকারের চাহিদা মোতাবেক ওই কেন্দ্রে মোট ভোটের যত সংখ্যক প্রয়োজন তত সংখ্যক ভোটের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসাররা। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত ইভিএমের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতির পথ ক্ষমতাসীন দলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।”

কোনো কারণে কারও আঙুলের ছাপ না মিললে সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বিধি মেনে মোট ভোটারের সর্বোচ্চ ১ শতাংশকে ভোটার হিসেবে শনাক্ত করে ইলেকট্রনিক ব্যালট ইস্যুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। ভোটের দিন অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলায় সেই হার বাড়ানো হলেও কতটুকু বাড়ানো হয়, সেটা ইসি জানায়নি।তবে সিইসি বলেছেন, ইভিএমে কখনও একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে না। একবার ভোট দেওয়া হয়ে গেলে ওই লোক আরেকবার পারে না।

তাহলে এই নির্বাচনে ইসির প্রাপ্তি কী- এক কথায় ভিন্নমত প্রকাশের জন্য আলোচিত মাহবুব তালুকদার বলেন, “ইভিএম ব্যবহার করে এই নির্বাচনে সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে, এতে কোনো কেন্দ্রে ১০০% ভোট পড়েনি এবং নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভর্তি করার সুযোগ ছিল না। এই অপবাদ থেকে আমরা মুক্ত।”নির্বাচন পর্যবেক্ষক কলিমউল্লাহর মতে, ভোট বর্জনের চিরায়ত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন বড় অর্জন।

তিনি বলেন, “ভোট বর্জন ছিল না এবার। ভোট চলাকালীন সময়ে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেননি কোনো প্রার্থী। অংশগ্রহণমূলক ভোটের পরিবেশ শেষ বেলা পর্যন্ত ছিল।”

বিএনপির ভাষ্যে, এটা ছিল তামাশার নির্বাচন। দলটির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের নামে জাতির সাথে প্রতারণা ও তামাশা করেছে। ইভিএম মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি করেছে।”তবে ঢাকার এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে আস্থার পরীক্ষায় ফের উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন বলে সন্তুষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তার ভাষ্যে, “ইভিএমের মাধ্যমে দেওয়া এটা একটা পরীক্ষাও ছিল। আরেকটা পরীক্ষা ছিল, আমরা যে এত কাজ করলাম মানুষের জন্য তাহলে মানুষ আমাদের কতটুকু আস্থায় নেয়, বিশ্বাস করে এবং ভোট দেয় কি না সেটারও একটা টেস্ট হয়ে গেল।”

পাঠকের মতামত

Comments are closed.