190756

সিনেমার বদল ও ‘গহীন বালুচর’

 

ডেস্ক রিপোর্ট :চর জেগে উঠেছে—এই আনন্দের বার্তা দিয়ে গহীন বালুচর শুরু হয়ে যায়। ডুব এসে আলোচনায় ভাসিয়ে গেল, ভেসে এল হালদা, তারপর জেগে ওঠে গহীন বালুচর। তরুণ নির্মাতাদের চলচ্চিত্র একের পর এক দর্শক বরাবর হাজির হয়ে চলেছে—মহা আনন্দের বার্তা নিশ্চয়ই।

সময়টা চমত্কার। বুক ফুলিয়ে বলা যায়, চলচ্চিত্রের দুর্দিন ঘুচে যাচ্ছে, যাবে। অন্ধকার কাল খুব সহজে কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, এতটা আশা কিছুদিন আগে পর্যন্ত করা যায়নি। আশার আলো কখনো জ্বলেছে, কখনো হয়েছে নিবু নিবু। সেই নিবু নিবু থেকে হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো আবার কোনো ছবি রুপালি পর্দায় জাগিয়ে দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা, হইচই।

কয়েক বছর ধরে এই দৃশ্যান্তর—আশা, আনন্দ আর উত্তেজনার নাটকীয়তা চলমান। সবচেয়ে আনন্দ ও গৌরবের কথা, নতুনদের হাত ধরেই চলচ্চিত্রের এই নবযাত্রা। এই অভিযান নতুনতর আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনাকে প্রকাশ করে চলেছে। একটা বছর তড়িঘড়ি করে চলে গেল যেন। পেছনের দিনগুলোতে একেকটা চলচ্চিত্রের পর্দাছোঁয়া এবং তাল মিলিয়ে সিনেমার প্রতি দর্শকের কৌতূহল বেশ চোখে পড়ার মতো। নাম, গল্প, বিষয় ও নির্মাণে বিচিত্র আকর্ষণ নিয়ে একের পর এক চলচ্চিত্রগুলো হাজির হয়েছে। তা নিঃসন্দেহে সুলক্ষণ।

এখন বিয়ের মৌসুম। কাচ্চি বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও বা রেজালা টেবিলে এসে পৌঁছানোর আগে বেশ কয়েকটা বিয়েবাড়িতে সিনেমা নিয়ে আলাপ হতে শুনেছি। আহার শেষে কফি পানের বেলায়ও প্রসঙ্গ এখনকার সিনেমা। ভালো লাগার মতোই। গহীন বালুচর ছবিটা দেখে অনেকের খুবই ভালো লেগেছে। ভালো লাগার মতো উপাদান তো পুরো ছবিতে কম নেই। অজস্র ভালোর মধ্যে দু-চারটা মন্দের উঁকিঝুঁকি সে-ও অস্বাভাবিক নয়। বদরুল আনাম সৌদ চমত্কার লেখেন। টেলিভিশনের বহু সফল নাটক তিনি লিখে পরিচালনা করেছেন। অসংখ্য নাট্যকার ও নির্দেশকের ভিড়ে তিনি যে আলাদা, সে পরিচয় টেলিভিশন-দর্শক ভালো করেই জেনেছেন বহুবার। যখন গহীন বালুচর ছবির ঘোষণা হয়, অনেকেই আশাবাদী হয়েছেন যে সৌদের টেলিভিশন-সাফল্য চলচ্চিত্রেও আলো ছড়াবে।

নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা থাকলে কী না হয়। একটা গল্প চিন্তা করার বেলায় ভাবা হয়েছে আলাদা ধরনের হতে হবে। সেই গল্পের অভিনয়শিল্পীদের সবাইকে বিখ্যাত হতে হবে এমন ভাবলে দোষের কিছু ছিল না; কিন্তু ভিন্ন কিছু হোক এমন চিন্তায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কাহিনিকার-পরিচালক এনেছেন নতুন নতুন মুখ। সৌদ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নতুন, নিজের পয়লা ছবিতে আনকোরা নতুন অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে কাজ করার ঝুঁকি নিয়েছেন। এমন সাহস নিঃসন্দেহে তালি পেতে পারে। গহীন বালুচর-এর গল্পটা শুরু হওয়া থেকে গড়িয়ে শেষের দিকে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে বুদ্ধির দীপ্তি টের পাওয়া যায়। নতুনদের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি চরিত্রে পরিচালক যেসব খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী নির্বাচন করেছেন, তা-ও হিসেবি ও বুদ্ধিদীপ্ত। শুধু শিল্পী নির্বাচন নয়, চরিত্রগুলো বিশেষ ভাবনায় রচনা করা হয়েছে, যেন ছবির অলংকার হয়ে উঠতে পারে। শিল্পীদের অভিনয়ক্ষমতা নতুন বিস্ময় সৃষ্টি করে, হয়ে ওঠে আনন্দময়। সুবর্ণাকে যে ধরনের চরিত্রে সাধারণত ভাবা হয় না, ভিন্ন মাত্রায় এমন শিল্পীকে উপস্থাপন করা নিঃসন্দেহে আরেক সাহসের কাজ। একই সঙ্গে তা অভিনয়শিল্পীর জন্য ভিন্ন মাত্রার অনুভব, বিশেষ প্রাপ্তি। অদেখাকে দেখার আলাদা আনন্দ মেলে দর্শকেরও। টেলিভিশনের একসময়কার গুণী অভিনেতা সৈয়দ আহসান আলী সিডনীর সুপুত্র জিতু আহসান। গহীন বালুচর-এ তাঁর উপস্থিতি ও বিপুল সামর্থ্যের প্রদর্শন চমকে দেয়। জিতু এবং সিনেমার দর্শক—উভয়ের জন্যই তা নতুন পাওনা। দর্শক এই সু-অভিনেতাকে এই ছবিতে অভিনয়ের পর থেকে আলাদা মাত্রায় বিবেচনা করবেন। আরও একজন শিল্পীকে দর্শক বহু আগে থেকেই গুণবান বলে জানেন। ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয়ক্ষমতার সেই পরিধি আরও বিস্তৃত হলো গহীন বালুচর-এ অসাধারণ অভিনয়ের জন্য। রাইসুল ইসলাম আসাদের পরিমিত অভিনয়ও নজর এড়ায় না।

শুধু অভিনয়ের কথা বলা হচ্ছে। গহীন বালুচর ছবির অন্য ক্ষেত্রগুলোতেও রয়েছে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো অসংখ্য উপাদান। গল্পের ভুবন মাধুর্যময় করে তোলার জন্য প্রকৃতির রূপসৌন্দর্য ক্যামেরায় যথার্থভাবে ধারণ করা দরকার ছিল, তার ঘাটতি চোখে পড়ে না। ছবি নির্মাণের সময় পরিচালক নতুন আবহে প্রেমের গল্প বলতে চেয়েছেন। বাণিজ্য শব্দে পরিচালকের আপত্তি আছে মনে হয়নি। জেনে-বুঝে সৌদ বাণিজ্যিক ছবিই বানাতে চেয়েছেন, তা দোষের নয়। অনেকে আবার তেমন সিদ্ধান্ত উঁচু দরের বলে মনে করেন না। ছবিতে রয়েছে নৃত্যগীত। গান শ্রুতিমধুর। সাহসী অতি নবীন নজিবা বাশারকে দিয়ে কোরিওগ্রাফি করিয়েছেন সৌদ। তা সৃজনশীল, দৃষ্টিনন্দন; তবে বাণিজ্যিক শব্দে আপত্তি যখন নেই, নৃত্যের বেলায় আরও দ্বিধাহীন হওয়া যেত। পুরো মাত্রায় বাণিজ্যিক ছবি বানানোর ইচ্ছা থাকলে তা কি দোষের হতো?

ভালো ছবির জন্য দর্শকপ্রাণে কাতরতা কম নেই। বাণিজ্যিক ছবির জন্য সেই কাতরতা আরও প্রবল। ভালো আর বাণিজ্যিক—দুটি ধরনের কথা বলা হয়ে থাকে। সেই বলায় মনে হতে পারে গুণ থাকে বলে কোনো ছবি ভালো আর যে ছবিতে তার পরিমাণ কম থাকে তা বাণিজ্যিক। কোন সে গুণ, যা এই বিভক্তির কারণ। বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি নির্গুণ হয় তাতে দোষ থাকে এমনটা মেনে নেওয়ার কী কারণ? ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’—এ রকম একটা কৌশল অবলম্বনের প্রবণতা আমরা কেউই এড়াতে পারি না। পারি না বলেই বাণিজ্যিক শব্দের আগে ‘সুস্থ ধারার’ অভিধাটা জুড়তে হয়, কী দরকার? বাণিজ্যিক ছবি বিশেষ গুরুত্ব না দেওয়ার খেয়ালকে আমরা লালনপালন করে তুষ্ট থাকি। বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণের মধ্যে শিল্পমনস্কতা কি থাকে না! সৌদ দুটিকেই প্রয়োজন মনে করেন, টের পাওয়া যায়। সৌদ চলচ্চিত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করতে কোমর বেঁধে প্রথম ছবি নির্মাণে নেমে পড়েননি। গহীন বালুচর যেন দর্শকের মনে সুবাতাস বয়ে দিতে পরে, এমন সামান্য চাওয়াই ছিল তাঁর। সেই চেষ্টায় ঘাটতি চোখে পড়েনি, কিন্তু চাইলে সুবাতাসকে আরও খানিকটা জোরালো করতে পারতেন। গহীন বালুচর আরও বাণিজ্যিক হতে পারত। কী হতে পারত, তার বদলে যা পাওয়া হয়েছে, তা কম আনন্দের নয়। দোষ ধরতে চাইলে তার অভাব নেই। সে চর্চায় লাভ কার? সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ডুব, হালদা এবং এই গহীন বালুচর নিয়ে ভালো-মন্দ উভয় আলোচনাই হয়েছে বেশ। ভালো চেষ্টাকে স্বাগত জানানোতে একরকম উপকার। আর যদি মন্দ খোঁজায়, বলায় অতি আগ্রহ থাকে, ফল লাভ হয় ভিন্ন। মন্দের অজুহাতে অনেক দর্শক দায়িত্ববিচ্যুত হতে পারেন, তা শুভ নয়। কথাটা ভ্রু ভাঁজ করা। দর্শকের আবার দায়িত্ব কী? আমরা নিয়মিত বিষয়ে অভ্যস্ত। সিনেমা হলে নতুন সিনেমা মুক্তি পায়, দেখার আগ্রহে ২ জন বা ১০ জন মিলে দেখতে যাওয়া হয়। দেখে অনেকের ভালো লাগে, অনেকের লাগে না। ভালো যাঁদের লাগে, তাঁরা অন্যদের বলেন। অন্যদের দেখার আগ্রহ তাতে বেড়ে যায়। মন্দ লাগলে বলাবলি হয় তা-ও।

এই ভালো বা মন্দ লাগা এবং সে কথা বলাবলিতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই, তা দোষেরও নয়। যে মানুষ সিনেমা দেখতে যায়, ছবি সম্পর্কে মতামত তাঁর অধিকার। তাহলে দর্শকের দায়িত্বচ্যুতির প্রসঙ্গ কেন এল?

পেছনকালে আমাদের দেশের সিনেমার হাল রমরমা ছিল। নানান ধরনের সিনেমা তৈরি হতো। নানান ধরনের দর্শকও ছিল। বিদেশ থেকে ইংরেজি ছবি আসত, দেশে নির্মিত ছবিগুলো অধিকাংশই ছিল সদিচ্ছায় নির্মিত। সদিচ্ছা মানে, নির্মাতারা দর্শককে সম্মান-সমীহ করে, রুচি ও মর্যাদা মাথায় রেখে সিনেমা নির্মাণ করতেন। পারিবারিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক বা লোককাহিনি—সব রকমের গল্প পর্দায় এসেছে এবং সব ধরনের গল্পে দর্শকের আগ্রহের কথা জানা যায়। বর্ণনানুযায়ী, সময়টাতে বজায় ছিল স্বাভাবিকতা। একটা দেশে জ্ঞান, শ্রদ্ধা আর ভক্তি দিয়ে মানুষ সিনেমা বানাবে, মানুষই তা আয়োজন করে দেখতে যাবে। দায়িত্ব-কর্তব্যে উভয়ে উভয়ের জন্য। এই বোধ ছিল বলে চলচ্চিত্র বিশেষ আকর্ষণের ছিল। শিল্প বা বাণিজ্য কোনো দিকেই উপযুক্ততার ঘাটতি ছিল না।

সেই পরিপ্রেক্ষিত বদলেছে। আপন হয়েছে পর। সিনেমা আর সেই হুলস্থুল আগ্রহের জায়গায় নেই। পরকে আবার আপনের জায়গায় ফেরত আনতে অসংখ্য তরুণ নির্মাতা তাঁদের মেধা চেষ্টা, নিষ্ঠা সম্বল করে ভালোবেসে ঝাঁপ দিচ্ছেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। এমন ঝুঁকি নিচ্ছেন সানন্দে, সাগ্রহে। অজস্র সংকট তাঁরা পাহাড় ঠেলে লক্ষ্যে স্থির থাকছেন। সেই দৃঢ়তায় চলচ্চিত্র ধীরে ধীরে আবার আগ্রহ ও আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠছে। তরুণ নির্মাতাদের এই লড়াই সাধারণ দর্শকদের ফিরিয়ে দিচ্ছে অধিকার। ভালো লাগা, ভালোবাসা, আনন্দ-বিনোদনের অধিকার। নির্মাতারা পাহাড় ঠেলা কর্তব্য পালন করে চলেছেন। যাঁদের জন্য সিনেমা, সেই দর্শকের সে বিষয়ে আদৌ দায়িত্ব রয়েছে কি না, থাকলে কতখানি, কীভাবে পালন করতে পারেন, মনোযোগী হয়ে ভাবা হয় না।

যে দেশে চলচ্চিত্রের অবস্থান পাকাপোক্ত, সেখানে দর্শকের আগ্রহ, অনীহা, নিজ অধিকার নিজ নিজ মত থাকুক। আমাদের বেলায় বিবেচনার বদল দরকার। ছবি নির্মাণের সৎ চেষ্টাকে সমীহ দেখানোর উপায় হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া, অন্যকে দেখতে উত্সাহিত করা। দর্শকদেরও মনে করা উচিত, নির্মাতারা তাঁদের জন্যই ছবি বানান। সেই ছবির জন্য তাঁদেরও কর্তব্য রয়েছে। নিজের পকেটের সামান্য পয়সা স্বার্থপরের মতো খামচি মেরে ধরে রেখে কর্তব্য, দায়িত্ব পালন হয় না। যাঁরা দুঃসময়ে চলচ্চিত্রের সম্মান ফেরানোর চেষ্টায় এখানে-ওখানে হাত পেতে, নিজের সর্বস্ব লগ্নি করে মহাবিপদের ঝুঁকি মাথায় নিচ্ছেন, তাঁরা কেউ-ই কম বুদ্ধিমান নন। ভালোবাসার টানে, দায়িত্বশীলতা আর স্বপ্ন নিয়ে যাঁরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন, তাঁরা একা নন, সঙ্গে রয়েছেন সাধারণ, দায়িত্বশীল দর্শক। এমন প্রেরণা দেওয়া কঠিন কম্ম নয়। নির্মাতারা নিঃস্বার্থ হবেন আর দর্শক তাঁর স্বার্থ বাঁচিয়ে চলবেন—এমন একপেশে চেতনায় লোকসানের পাহাড় উঁচু হতে থাকবে। সেই লোকসান কোনো পক্ষের নয়, সমগ্রের।

ভয়কে জয় করে যাঁরা সিনেমা বানাচ্ছেন, তাঁরা নায়ক। সময়, গল্প, ভাবনা বদলে দেওয়ার নায়ক। আমরা যাঁরা দর্শক, সেই বদলের সঙ্গে যুক্ত হই। নিজ নিজ পকেটের সামান্য পয়সা সিনেমাকে অসামান্য জায়গায় ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যয় করি। সানন্দে ছবি দেখতে যাই, সগৌরবে বলি, সিনেমার বদল ঘটছে। আমরা সঙ্গে রয়েছি, বাঁচুক সিনেমা। সুত্র প্রথম আলো

পাঠকের মতামত

Comments are closed.