192332

একটানা ১১ দিন না ঘুমিয়ে যেভাবে বিশ্বরেকর্ড করেন মার্কিন বালক

ডেস্ক রিপোর্ট :১৯৬৪ সালের ৮ই জানুয়ারী। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্ণিয়ার স্যান ডিয়েগোর এক স্কুল বালক বিরাট হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। একটানা এগারো দিন না ঘুমানোর বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করেছে সতের বছরের র‍্যান্ডি গার্ডনার।

পুরো ঘটনাটি শুরু হয়েছিল স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় কী করা যায়, সেরকম একটি ভাবনা থেকে। র‍্যান্ডি এবং তার বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা মানুষের ঘুম নিয়ে কোন একটা পরীক্ষা চালাবে। সেই বন্ধুদের একজন ব্রুস ম্যাকালিস্টার।

ব্রুস এবং তাঁর বন্ধু র‍্যান্ডি গার্ডনার সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা একটানা জেগে থাকার যে বিশ্ব রেকর্ড, সেটা ভাঙ্গবেন। তখন এক্ষেত্রে বিশ্বরেকর্ডটি ছিল হনলুলুর এক ডিস্ক জকি বা ডিজে’র। একটানা ২৬০ ঘণ্টা অর্থাৎ এগারো দিনের একটু কম সময় জেগে ছিলেন তিনি।

উইলিয়াম ডিমেন্ট তখন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ গবেষক। স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি তার নজর কাড়লো। তিনি বলেন, “আমি এ ঘটনার কথা প্রথম পড়ি সংবাদপত্রে। সান ডিয়েগোর পত্রিকায় এই ছেলেটাকে নিয়ে একটা খবর বেরিয়েছিল। সে নাকি না ঘুমিয়ে একটানা জেগে থাকার একটা নতুন রেকর্ড করতে চায়। কাজেই আমি সাথে সাথে ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। যাতে করে আমি এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারি এবং দেখতে পারি কিভাবে ব্যাপারটা কাজ করছে।”

উইলিয়াম ডিমেন্ট এখন ক্যালিফোর্ণিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক। বিশ্বে ঘুম নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে তাকে পথিকৃৎ বলে মনে করা হয়।

র‍্যান্ডি গার্ডনার এবং তার বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার এবং অন্যরা মিলে ঘুম নিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন।

ব্রুস ম্যাকালিস্টার বলেন, “আমরা একটা কয়েন দিয়ে টস করে ঠিক করছিলাম, একটানা জেগে থাকার এই রেকর্ডটি কে করবে। আমি খুশি ছিলাম যে র‍্যান্ডির ভাগ্যেই এই দায়িত্বটা পড়লো। আমি হয়তো ওর চেয়ে অনেক আগেই ঝিমিয়ে পড়তাম। কিন্তু তখনো আমরা আসলে একরকম নির্বোধই ছিলাম, বলতে পারেন নিরেট গাধা। র‍্যান্ডিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাকেও ওর সঙ্গে জেগে থাকতে হচ্ছিল। ওর ওপর নানা ধরণের পরীক্ষা চালাতে হচ্ছিল। কিন্তু তিন রাত ধরে নির্ঘুম থাকার পর একদিন দেয়ালের ওপর গিয়ে টলে পড়লাম। সেই দেয়ালের ওপরই তখন আমি নোট লিখছিলাম। তখন আমরা বুঝতে পারলাম, অন্য কাউকে এই কাজের জন্য নিয়ে আসতে হবে। তখন আমাদের আরেক বন্ধু জো মার্সিয়ানোকে অনুরোধ করলাম সে এই কাজে যোগ দিতে পারে কিনা। জো রাজী হলো।”

আর ঠিক ঐ একই সময়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক উইলিয়াম ডিমেন্টও এসে যোগ দিলেন তাদের সঙ্গে। উইলিয়াম ডিমেন্ট বলেন, সেসময় গোটা দুনিয়ায় সম্ভবত আমিই একমাত্র গবেষক, যার কিছু কাজ ছিল এই ঘুম নিয়ে। র‍্যান্ডির বাবা-মা খুব হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন যে আমি এই কাজে যুক্ত হয়েছি। এই একটানা না ঘুমানোর ফলে র‍্যান্ডির কোন ক্ষতি হবে বলে আশংকা করছিল তার বাবা-মা। মানুষ যদি একটানা দীর্ঘ সময় না ঘুমায়, তাহলে এর ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে কিনা, সেই প্রশ্নের কোন মীমাংসা তখনো হয়নি।”

এর আগে কিছু বিড়ালের ওপর এধরণের গবেষণা হয়েছিল। বিড়ালগুলোকে ১৫ দিন পর্যন্ত জাগিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এরপর বিড়ালগুলো মারা যায়।

ব্রুস ম্যাকালিস্টার বলছেন, তবে সেই পরীক্ষার সঙ্গে তাদের পরীক্ষার একটা পার্থক্য ছিল। তিনি বলেন, “কিন্তু সেসব বিড়ালকে আসলে জাগিয়ে রাখা হয়েছিল নানা রকম রাসায়নিক প্রয়োগ করে। তখনো কেউ জানতো না যে সে কারণেই আসলে বিড়ালগুলো মারা গিয়েছিল। র‍্যান্ডি মাঝে মধ্যে কোক খেত। কিন্তু এ ছাড়া আর কিছু নয়। ডেক্সিড্রিন, বেনযিড্রিন বা এ জাতীয় কোন উদ্দীপক ঔষধ কিন্তু র‍্যান্ডি নেয়নি।”

ঘুম নিয়ে এই পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল সান ডিয়েগো ব্রুসের বাবা-মার বাড়িতে। উইলিয়াম ডেমেন্ট যখন সেখানে পৌঁছালেন, র‍্যান্ডিকে তখনও বেশ উজ্জীবীত দেখাচ্ছিল। র‍্যান্ডির ওপর তখন নানা রকম পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্রুস ম্যাকলিস্টার এবং তার বন্ধুরা।

তিনি বলেন, “তখন আমরা তরুণ সৌখিন বিজ্ঞানীরা যা করছিলাম, তা হলো, যতরকমের পরীক্ষা চালানো সম্ভব, আমরা সেগুলো চালানোর চেষ্টা করছিলাম। যেমন স্বাদ, গন্ধ, শ্রবণশক্তি এসবের ওপর। এরপর আমরা দেখতে পেলাম ধীরে ধীরে তার সজ্ঞান থাকার ক্ষমতা, এমনকি তার ইন্দ্রিয় অনুভূতির ওপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সে হয়তো বলতে লাগলো, ঐ গন্ধটা আমার ভালো লাগছে না, আমাকে ওটার গন্ধ শুকতে বলো না। কিন্তু এর বিপরীতে সে কিন্তু আবার বাস্কেটবল খেলায় ভালো করছিল।”

উইলিয়াম ডেমেন্ট মনে করতে পারে, রাতের পর রাত জেগে থাকার কারণে সেরকম বড় কোন শারীরিক অসুবিধা হয়নি র‍্যান্ডির।

তিনি বলেন, “সে শারীরিকভাবে খুবই ভালো ছিল। কাজেই আমরা তাকে বাস্কেটবল খেলতে নিয়ে যেতাম, বোলিংয়ে নিয়ে যেতাম। যদি তখন সে চোখ বন্ধ করতো, তাহলে কিন্তু সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়তো। ও যখন চোখ বন্ধ করতো, আমি বলতাম, র‍্যান্ডি চোখ খোল। ও যখন চোখ খুলতো না, আমি তখন তাকে খোঁচা দিতাম। তবে তাকে এভাবে খোঁচা দেয়ায় সে বিরক্ত হয়েছে আমি সেটা দেখিনি।”

ব্রুস ম্যাকালিস্টার বলছিলেন, এই পরীক্ষা রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিল মিডিয়ায়। সাংবাদিকরা তো বটেই, ভিড় করছিলেন আরও অনেকে র‍্যান্ডিদের বাড়িতে।

তিনি বলেন, “তখন অনেক মেয়ে এসে ভিড় করেছিল র‍্যান্ডিকে দেখতে। র‍্যান্ডি ছিল খুবই সুদর্শন এবং আকর্ষণীয়। তারপর সাংবাদিকরাও এসে ভিড় করতে থাকলো। তবে বেশিরভাগ মিডিয়ার কভারেজে এটাকে এক ধরণের ধোঁকাবাজী হিসেবে দেখানো হচ্ছিল। আমাদের এই পরীক্ষাকে তখন গোল্ডফিশ গিলে খাওয়ার মতো নানা কিছুর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছিল।”

কিন্ত আসলেই কি এরকম কোন ধোঁকাবাজির চেষ্টা তাদের এই পরীক্ষাতে ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “না, মোটেই না। লাইফ ম্যাগাজিনের একজন সাংবাদিক সহ কয়েকজন একবার র‍্যান্ডি, জো এবং আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল। আমাদের স্কুলের যে প্রিন্সিপ্যাল ছিল, তিনিও এটাকে একটা ধোঁকাবাজি মনে করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি আমরা ক্রিসমাসের ছুটির পর স্কুলে ফিরে না যাই, আমাদের সাজা দেয়া হবে। তো লাইফ ম্যাগাজিনের এই সাংবাদিক আমাদের বলছিল, তোমাদের প্রিন্সিপ্যালের এই হুঁশিয়ারি নিয়ে চিন্তা করো না। সে যদি তোমাদের বিরুদ্ধে কিছু করে, আমাদের বলো।”

সেসময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এটি নিয়ে এত বেশি মাতামাতি হচ্ছিল যে, জন এফ কেনেডির হত্যাকান্ড এবং পপ ব্যান্ড বিটলসের সফরের পর এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি আলোচিত সংবাদ। কিন্তু যারা ঘুম নিয়ে এই পরীক্ষা চালাচ্ছিল, তাদের জন্য তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেজ্ঞ র‍্যান্ডিকে কিভাবে সজাগ রাখা যায়।

উইলিয়াম ডিমেন্ট বলছিলেন, তাদের নিজেদেরও কষ্ট করে রাত জাগতে হচ্ছিল তখন। তিনি বলেন, “আমরা তাকে মধ্যরাতে গান বাজিয়ে শোনাতাম। তাকে সজাগ রাখতে আমাদের হিমসিম খেতে হচ্ছিল। কারণ মধ্যরাতে তো আর তেমন কিছু করার থাকে না। দিনের বেলায় তো আমরা অনেক কিছুই করতে পারি। আমরা দিনের বেলায় অনেক কিছু করতাম। কিন্তু রাত ছিল ভয়ংকর। কারণ র‍্যান্ডিকে জাগিয়ে রাখা শুধু নয়, আমাদেরও জেগে থাকতে হতো।”

কষ্ট করে হলেও তারা এই পরীক্ষা চালিয়ে গেলেন। ১১ দিনের এই দীর্ঘ পরীক্ষা শেষে র‍্যান্ডি তার বাবা-মার বাড়ির বাইরে এক সংবাদ সম্মেলন করেন।

উইলিয়াম ডিমেন্ট বলেন, “সেখানে বিরাট একটা দল জড়ো হয়েছিল। তারা র‍্যান্ডিকে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিল। কিভাবে র‍্যান্ডি এই কাজ করেছে। কিরকম সাহায্য পেয়েছে। তারপর একজন প্রশ্ন করলো, এই পুরো পরীক্ষার অর্থটা কী দাঁড়ালো। র‍্যান্ডি জবাব দিয়েছিল, এর মাধ্যমে প্রমাণ হলো, মানুষের শরীরের চাইতে মন অনেক বেশি শক্তিশালী।”

র‍্যান্ডি একদম না ঘুমিয়ে একটানা জেগে ছিলেন ২৬৪ ঘন্টা, অর্থাৎ প্রায় এগারো দিন। কিন্তু এই ভয়ংকর কষ্টকর পরীক্ষায় অংশ নেয়ার পর র‍্যান্ডি কি করলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে উইলিয়াম ডিমেন্ট বলেন, “এরপর র‍্যান্ডি একটানা ১৪ ঘন্টা ঘুমিয়েছিলেন। আমরা এতে অবাক হইনি। তাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছিল, কারণ তার বাথরুম পেয়েছিল। যে ধরণের ঘুমকে আমরা র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট, বা ‘রেম’ বলি, অর্থাৎ ঘুমের যে পর্যায়টাতে আমরা স্বপ্ন দেখি বলে তখনো মনে করা হতো, তা দেখা গেল র‍্যান্ডির বেলায় তা বেশ বেড়ে গেছে। তবে পরের রাত থেকে তা কমতে থাকলো। এক পর্যায়ে এই ‘রেম’ ঘুম স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসলো।”

১৪ ঘন্টার প্রথম ঘুম থেকে জেগে উঠার পর র‍্যান্ডি স্কুলে গেলেন। ততদিনে তিনি না ঘুমানোর বিশ্বরেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছেন। পরবর্তী বছরগুলোতে অনেকেই তার এই রেকর্ড ভাঙ্গার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গিনেজ বুক অব রেকর্ড এখন আর এ ধরণের চেষ্টা কেউ করলে সেটাকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। কারণ তারা মনে করে এভাবে দীর্ঘদিন একটানা না ঘুমিয়ে অনেকে তাদের জীবন বিপন্ন করতে পারে।

ব্রুস ম্যাকালিস্টার র‍্যান্ডির এই পরীক্ষা অবশ্য ঘুম নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের জন্য অনেক মূল্যবান তথ্য যুগিয়েছিল।

উইলিয়াম ডিমেন্ট বলেন, “এই গবেষণা থেকে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা আমরা জানতে পেরেছি তা হলো, এই পরীক্ষার সময় আসলে র‍্যান্ডির মস্তিস্কের কোন কোন অংশ ঘুমাচ্ছিল। আরিজোনার একটি সুপারকম্পিউটার এই গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে এই উপসংহারে পৌঁছেছিল। অর্থাৎ র‍্যান্ডির মস্তিস্কের একটি অংশ ঘুমাচ্ছিল, অন্য অংশ সজাগ ছিল। আবার হয়তো সজাগ অংশ ঘুমে চলে যাচ্ছিল। আর ঘুমিয়ে থাকা অংশ জেগে উঠছিল। আমরা যদি আমাদের বিবর্তনের প্রক্রিয়ার কথা ভাবি, এটা বোঝা খুব কঠিন নয়। অর্থাৎ আমাদের মস্তিস্ক-কে এভাবে খাপ খাইয়ে নেয়া সম্ভব, মস্তিস্কের একটি অংশ যখন ঘুমাবে, অন্য অংশ জেগে থাকবে। এ কারণেই হয়তো এই পরীক্ষার সময় খুব খারাপ কিছু ঘটেনি।”

১১ দিন না ঘুমানোর কারণে র‍্যান্ডি গার্ডনারের ওপর এর কোন তাৎক্ষণিক খারাপ প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদিও অনেক পরে তিনি ইনসমনিয়া বা নিদ্রাহীনতায় ভুগেছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন। র‍্যান্ডির বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার পরে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখক হয়েছিলেন। আর উইলিয়াম ডেমেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা ঘুম গবেষক হিসেব নাম করেন।সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

পাঠকের মতামত

Comments are closed.