195330

সমাধিতে এক তুখোড় সমালোচক

মূলগত দিক দিকে সমাধি মানে ‘যাতে মন সমাহিত করা যায়’। তবে শব্দটির চলতি অর্থ কবর, গোর (কুরুক্ষেত্র অবিচল নিত্যো সমাধি- সুধীন্দ্রনাথ দত্ত; কিন্তু ও কি সহচরি? সমাধির তলে? ওই শয্যার উপরে? মুমূর্ষু এন্টনি, ক্লিওপেট্রা- নবীনচন্দ্র সেন; শূন্য এই মরমের সমাধি-গহ্বরে, জ্বলিছে এ প্রেমশিখা চিরকাল তরে, কেহ না দেখিতে পায়, থেকেও না থাকা প্রায়, নিভিবারও নাম নাই নিরাশার ঘোরে- গভীর গভীরতম হৃদয়প্রদেশে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; শিউলি ঢাকা মোর সমাধি প’ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি’!- অভিশাপ, কাজী নজরুল ইসলাম; তাহার ভাবনার, তাহার বাসনার, তাহার পরম সুখের, চরম দুঃখের, তাহার সুদুঃসহ বেদনার আজ তাহার চোখের উপরেই সমাধি হইল, কিন্তু ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস পর্যন্ত সে পড়িতে দিল না- চরিত্রহীন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; প্রথমে উপাধি পাইয়াছিলেন, এবার সমাধি পাইলেন, তিনি বিলাতী ব্রহ্মে লীন হইলেন- কমলাকান্তের দপ্তর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; যাহাতে চিত্ত সমাহিত হয়, তাহাই ‘সমাধি’- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর অভিধানে লিখেছেন ‘এক বিষয়ে মনোনিবেশই ‘একাগ্রতা’, একাগ্রতা বদ্ধমূল হলেই তার নাম ‘ধারণা’, ধারণা বদ্ধমূল হলেই তাকে ‘ধ্যান’ বলে, ধ্যান বদ্ধমূল বা গাঢ় হলেই ওই ধ্যানকে ‘সমাধি’ বলে।

সমাধি দশায় অহংজ্ঞান থাকে না। কেবলমাত্র ধ্যেয় বস্তুরই আভাস থাকে (বসুন্ধর বসুন্ধরা অন্নদার শাপে, সমাধিতে দিয়া মন তনু ত্যজে তাপে- অন্নদামঙ্গল)। তিনি পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার ঐক্য ভাবকে ‘সমাধি’ বলেছেন।

এছাড়া তাঁর বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে সমাধির বর্তমানে প্রচলিত অর্থ ছাড়াও আরো অনেক অর্থ নির্দেশ করেছেন। যেমন ইন্দ্রিয় সংযম, বাকসংযম, কাব্যের গুণবিশেষ (যে গুণ থাকলে বাক্যের মধ্যে কোথাও গাঢ়তা কোথাও শিথিলতা প্রকাশ পায়), অর্থালঙ্কার বিশেষ (দৈবানুকূল্যে হঠাৎ অন্য উপায়ের মাধ্যমে আরব্ধ বিষয় অনায়াসে সম্পন্ন হলে সমাধি অলঙ্কার হয় (হেন বাণী শুনি কৌরব মণি যুড়িল যেমন চাপে অশনি। খরবাতসহ অমনি রঙে দানব নগরে উল্কা পড়ে- নিবাতকবচ বধকাব্য), বিবাদভঞ্জন, আরোপ, অসাধ্য বিষয়ে অধ্যবসায়, ভবিষ্যযুগের জৈনমুনি বিশেষ, সমাধান, ‘সমাধান করিয়া’র সংক্ষেপ (ভোজন সমাধি সব কৈল আচমন- কবিকঙ্কণ চণ্ডী) ইত্যাদি।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ধ্যান বা প্রগাঢ় তন্ময়তা অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেছেন (কোন রঙ্গে ভঙ্গ করি তার সমাধি)। শব্দটির গঠন হচ্ছে সংস্কৃত সম্ + আ + (ধা + ই।

অন্যদিকে সংস্কৃত সম্ + আলোচক= সমালোচক। বিশেষণ এ পদটির সংস্কৃত অর্থ দোষগুণের সম্যক বিচার করে এমন; সাহিত্য ও শিল্পকর্মাদির বিবরণসহ যথোপযুক্ত বিচারকারী। শেষের অর্থে সমালোচকের ইংরেজি প্রতিশব্দ critic।

কিন্তু বাংলায় শব্দটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কারণ বাংলায় সমালোচক অর্থ দোষ ধরে এমন (১০জন মিলে সমালোচনার নামে আড়ং ধোলাই দিলেন; সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাও আর সমালোচনার নামে ইতরামো করে যাও- কারাগারে আঠার বছর, আজিজুল হক; এক্ষণে তপস্যাবলে ব্রহ্মার বরে তুমি বঙ্গদেশে সমালোচক হইয়া অবতীর্ণ হইয়াছ- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; যাঁহারা বড় সাহিত্যিক, বড় সমালোচক তাঁহারা পরামর্শ দিতেছেন, উপদেশ দিতেছেন ইংরাজি ভাব, ইংরাজি ভঙ্গী ত্যাগ করিয়া খাঁটি স্বদেশী হইতে- মাতৃভাষা এবং সাহিত্য, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; যাঁহারা উপযুক্ত সমালোচক তাঁহাদের নিকট একটা দাঁড়িপাল্লা আছে; তাঁহারা সাহিত্যের একটা বাঁধা ওজন এবং সেইসঙ্গে অনেকগুলি বাঁধি বোল বাহির করিয়াছেন, যে কোনো রচনা তাঁহাদের নিকট উপস্থিত করা যায় নিঃসংকোচে তাহার পৃষ্ঠে উপযুক্ত নম্বর এবং ছাপ মারিয়া দিতে পারেন- লোকসাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; একজন বিজ্ঞ সমালোচক একজন আগন্তুককে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘এই খনার স্ত্রী লীলাবতী বড় (mathematician) ছিলেন; দীনবন্ধু বাবু তাঁরি বিষয়ে নাটক লিখেছেন- অন্যান্য গদ্যসংগ্রহ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। সমালোচকের স্ত্রীলিঙ্গ সমালোচিকা।

ব্রেকিংনিউজ/

পাঠকের মতামত

Comments are closed.