195430

বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম কিশোর ক্ল্যাসিক ‘চাঁদের পাহাড়’

ছেলেরা জানে জোর না করলে স্যর কোনদিন ই ভালোমন্দ কিছু খাবে না। তাদের স্যর যে বড় গরীব !!

 

কাঁটায় কাঁটায় ১০.০৫ এ শেয়ালদায় ঢুকল ডাউন বনগাঁ লোকাল। ট্রেন থকে নামলেন এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। গোলগাল হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। হাতে জ্বলন্ত বিড়ি, বগলে ভাঁজ করা বহু পুরানো একটা ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক পত্রিকা। ইনি খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলের বাংলার মাস্টার। আপাতত তাঁর গন্তব্য কলুটোলা লেনের একটি একচিলতে ঘর। বর্তমানে ঘরটি কয়েকটি তের—চোদ্দো বছরের কিশোরের দখলে। এরা সবাই খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়ালের ছাত্র। তারা ঘরটি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছে, এলোমেলো হয়ে থাকা বই, কাগজপত্তর গুছিয়ে রাখছে। স্কুলের সময় প্রায় হয়ে গেছে তবুও ছেলেগুলি এখন এখান থেকে নড়বে না। স্যর যেদিন দেশের বাড়ি থেকে ফেরে, সেদিন এটাই তাদের রুটিন। তারা জানে স্যর বাড়ি থেকে খেয়ে আসে না, নিচের পাইস হোটেলে খায়। স্যরের খাওয়া হলে তারা একসঙ্গে স্কুলে যাবে। আর তাছাড়া যা আপনভোলা মানুষ! তাড়াহুড়োর সময় হয়তো না খেয়েই চলে যাবে।

 

স্যর ঘরে ঢুকতেই আবীর বললো, ‘স্যর, ঠাকুর বলল, আজ ভালো ইলিশ এসেছে… আপনার জন্য রাখতে বলেছি।’

 

‘সে কি রে ? ইলিশের দাম জানিস ? আমার দু’দিনের খাওয়ার খরচ হয়ে যেত।’

 

‘তা হোক স্যর, একদিনই তো! চলুন, চলুন… ভাত ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

 

ছেলেরা জানে জোর না করলে স্যর কোনদিন ই ভালোমন্দ কিছু খাবে না। তাদের স্যর যে বড় গরীব!

 

খাওয়ার পর গুরু শিষ্য সদলবলে ট্রামে চেপে চলল স্কুলে। ছুটির পর আবার খুদের দল। এবার সংখ্যায় আরও বেশি।

 

‘তোরা এবার বাড়ি যা তো, সন্ধে হয়ে গেলে বাড়িতে বকবে।’

 

‘বাড়িতে বলে এসেছি। আপনার সঙ্গে থাকলে মা বকেনা।’ সবথেকে খুদে রফিক ততক্ষনে স্যরের আঙুল ধরেছে। তার ভয়, ছোট বলে পাছে তাকে স্যর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।

 

ঘরে ফিরে এবার হাফপ্যান্টের পকেট থেকে বেরোতে লাগল স্যরের জন্য আনা বিচিত্র সব খাদ্যসামগ্রী। চিনেবাদাম, ছোলাভাজা, তেঁতুলের আচার, শোনপাপড়ি…এরকম কত কী!

 

রফিক তার স্কুলব্যাগে নিয়ে এসেছে আস্ত ডিমসেদ্ধ। স্যর রাত্রে খাবে। রফিকের বাবা কাছেই চায়ের দোকান করে। খুবই গরীব। স্যরের চোখের কোনটা কী ভিজে উঠল? কোথা থেকে আসে এইসব শাপভ্রষ্ট দেবশিশুর দল। এত মায়ার বাঁধন!

 

বিচিত্র খাদ্যসামগ্রী দিয়ে বিচিত্রতর জলযোগ শেষ হল গুরুশিষ্য সকলের। সবাই গোল হয়ে বসল, মাঝখানে তাদের স্যর। শুরু হল গল্প বলা। মুহূর্তে মুছে গেল কলকাতা শহর, ট্রাম-বাসের আওয়াজ, মহানগরীর কল-কোলাহল। এক অলীক স্বপ্নরাজ্যে ঢুকে পড়েছে ছেলেরা..স্যর বলে চলেছেন…

 

“শঙ্কর একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে…”

 

এভাবেই শুরু এক আশ্চর্য নির্মাণ… বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম কিশোর ক্ল্যাসিক ‘চাঁদের পাহাড়’। আর হ্যাঁ, ছাত্রদের চোখের মনি এই গরীব মাস্টারই অমর কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর হৃদয়ে ছাত্রদের জন্য সঞ্চিত ছিল এক সমুদ্র ভালোবাসা। …

পাঠকের মতামত

Comments are closed.