231653

বিশ্বের সবচেয়ে কম খরচে কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপন

অনলাইন সংস্করণঃ- ল্যাবএইড হাসপাতালের অর্থোপেডিক ও আর্থোপ্লাস্টি সেন্টারের চিফ কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেনের তত্ত্বাবধানে দেশে কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপন (হিপ অ্যান্ড নি রিপ্লেসমেন্ট) সার্জারিতে এসেছে বৈপ্লবিক সাফল্য। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এ পর্যন্ত তিন হাজারেরও বেশি সার্জারির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি, যার সফলতা ৯৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী ব্যয়বহুল এই চিকিৎসাকে তিনি দেশের মানুষের হাতের নাগালে এনেছেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন কথা বলেছেন প্রতিস্থাপন সার্জারি নিয়ে

কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে বলুন।
ডা. এম আমজাদ হোসেন : অর্থোপেডিক সার্জারিতে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপন। মানবদেহের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভাবন করেছে টাইটেনিয়াম ও সিরামিক অ্যান্ড সিরামিক ইমপ্লান্ট (এক ধরনের টাইটেনিয়াম মেটাল বা সিরামিক দিয়ে তৈরি কৃত্রিম জয়েন্ট)। ঊরুর হাড়ের মাথা নিতম্বের অস্থিসন্ধিতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে হেডের মাথা নষ্ট হয়। তখনই মৃত বা নষ্ট হেড কেটে ফেলে আর্টিফিশিয়াল ইমপ্লান্ট বসানো হয়। মাজায় একটা ইনজেকশন দিয়ে অবশ করে পুরো অজ্ঞান না করেই এ ধরনের সার্জারি করা হয়। অপারেশন-পরবর্তী দু-তিন দিন হাসপাতালে থাকতে হয় এবং অপারেশনের পরদিন থেকেই রোগীকে দাঁড় করানো, হাঁটাচলা বা ব্যায়াম করতে দেওয়া হয়। এ অপারেশনে রোগীর তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। চিকিৎসার পর তেমন কোনো সমস্যা ছাড়াই রোগী ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।

কোন পর্যায়ে কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়?
ডা. এম আমজাদ হোসেন : কোমর বা হাঁটুর সমস্যা যেকোনো বয়সেই হতে পারে, তবে বৃদ্ধ বয়সে এর প্রকোপ বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া কোনো কারণে আঘাত পেলে, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যাংকাইলোজিং স্পন্ডাইলোসিস, হাড়ের পরিবর্তন, হাড় ক্ষয়, হাড়ের টিউমার, হাড়ে টিবি, অস্থিতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধসহ অন্যান্য অসুখে যখন কোমর ও হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায়, যখন অন্য কোনো চিকিৎসা দিয়েও রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব হয় না, তখনই কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপন সার্জারির পরামর্শ দেওয়া হয়। হাঁটুর ক্ষেত্রেও একই রকম পরামর্শ। হাঁটুর মাঝে যে অস্থিসন্ধি বা কার্টিলেজ থাকে, তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হতে থাকে এবং কারো কারো ক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারণ করে। হাঁটুতে বারবার স্টেরয়েড ইনজেকশন নিতে নিতে অনেকের ইনফেকশন হয়ে যায়, হাঁটু বাঁকা হয়ে যায়, হাঁটতে অনেক কষ্ট এবং ঘুমাতে সমস্যা হয়। শুধু তীব্র ব্যথা ও যন্ত্রণাই নয়, বরং পুরো জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। ওই পর্যায়ে টোটাল নি রিপ্লেসমেন্ট বা হাঁটু প্রতিস্থাপন সার্জারির বিকল্প কোনো উপায় থাকে না। হাঁটু অকার্যকর হয়ে গেলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা অপসারণ করে আমেরিকার তৈরি ধাতব বা টাইটেনিয়াম ইমপ্লান্ট (কৃত্রিম হাঁটু) প্রতিস্থাপন করা হয়। মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে এই অপারেশন করতে।

যেকোনো বয়সেই কি প্রতিস্থাপন করা যায়?
ডা. এম আমজাদ হোসেন : ষাটোর্ধ্ব রোগীদের বেশি প্রতিস্থাপন সার্জারি করা হয়ে থাকে। তবে কোমর প্রতিস্থাপন সার্জারির ক্ষেত্রে কম বয়স AVN, Steroid induce, Ankylosing Spondylosis, Rheumatoid Arthritis, TB Hip কোনো ব্যাপার নয়। কোনো মানুষ যখন চলাফেরা করতে পারে না, তখন জীবন স্থবির হয়ে যায়। কোনো ওষুধ তখন কাজ করে না। ওই সময় কোমর প্রতিস্থাপন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প উপায় থাকে না।

আমাদের সেন্টারে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সের ১৫০ থেকে ২০০ রোগীকে প্রতিস্থাপন সার্জারি করে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। ৪০-৫০ বছরের আগে হাঁটু প্রতিস্থাপন না করাই উত্তম। তবে আঘাতপ্রাপ্ত, অনেক কষ্ট বা যন্ত্রণা পাচ্ছে এ রকম রোগীদের ক্ষেত্রে ভিন্ন।

এ পর্যন্ত কতগুলো প্রতিস্থাপন সার্জারি করেছেন? বাংলাদেশে সাফল্যের হার কেমন?
ডা. এম আমজাদ হোসেন : ২০০৪ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং ২০০৭ সাল থেকে ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়মিতই এ অপারেশন পরিচালনা করে আসছি। এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপন সার্জারি সম্পন্ন করেছি। সবার দোয়ায় অনেক পঙ্গু ও অসহায় মানুষকে একটি সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। আমাদের এখানে কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপন সার্জারির সাফল্যের হার ৯৯ শতাংশ।

কোমর ও হাঁটুর জয়েন্ট নষ্ট হলে রোগীদের কী সমস্যা হয়?
ডা. এম আমজাদ হোসেন : এটা এক অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। তাদের কষ্ট দেখলে বিবেক নড়ে ওঠে। অনেকের দাঁড়িয়ে মলমূত্র ত্যাগ করতে হয়, তীব্র ব্যথা ও যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে, চলাফেরা করতে পারে না, একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অনেকে। মোটকথা, পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় এসব রোগী। একসময় আপনজনরাও তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। অথচ একটু সচেতন হলেই জটিল এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

দেশের বাইরে এই চিকিৎসার খরচ কেমন?
ডা. এম আমজাদ হোসেন : হিপ রিপ্লেসমেন্ট বাবদ আমেরিকায় খরচ হয় ৫০-৫৫ হাজার ইউএস ডলার, সিঙ্গাপুরে ৩০-৩৫ হাজার ইউএস ডলার, থাইল্যান্ডে ২০-২৫ হাজার ইউএস ডলার, ভারতে ১০-১২ হাজার ইউএস ডলার আর বাংলাদেশে অর্থাৎ আমাদের সেন্টারে খরচ হয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার ইউএস ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। বলা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে কম খরচে এই চিকিৎসা আমরা বাংলাদেশে দিচ্ছি। রোগীদের মধ্যে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা এখনো বেশি। তবে প্রচারের অভাবে দেশে এ ধরনের সফল অস্ত্রোপচারের সংবাদ অনেকেই জানে না। এ কারণেই তারা বিদেশমুখী হচ্ছে। অনেকে দেশের বাইরে থেকে অপারেশন করে আমার চেম্বারে ফলোআপ করতে এসে তাদের কষ্টের গল্প শেয়ার করছে। তারা বলছে বিদেশে অনেক টাকা খরচ, তাদের ভাষা বুঝি না, আপনজনের দেখা পাই না, ফলোআপ করতে পারছি না ইত্যাদি সমস্যার কথা। তাই দেশে সাফল্যের এসব গল্প ফলাও করে মানুষের মাঝে প্রচার করা প্রয়োজন। আমি গণমাধ্যমকে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে অনুরোধ করব।

দরিদ্র রোগীদের জন্য এই চিকিৎসার সুযোগ কেমন?
ডা. এম আমজাদ হোসেন : দরিদ্র রোগীদের জন্যও অনেক কম খরচে আমাদের সেন্টারে অপারেশন করে আসছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে দরিদ্র রোগীদের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, সিএমএইচ, সিআরপি (সাভার), রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অর্থোপ্লাস্টি সেমিনার করাসহ বিনা মূল্যে প্রায় ১০০ রোগীর প্রতিস্থাপন সার্জারি করেছি।

আপনি মুক্তিযুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে ভারতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে নিজেই অর্থোপেডিক সার্জন হওয়ার মতো এমন জটিল বিষয়টি বেছে নিলেন কেন?
ডা. এম আমজাদ হোসেন : মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমার ঊরুতে গুলিবিদ্ধ হলে ভারতের সামরিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। বাংলাদেশে এসে ডা. আর জে গাস্ট নামের এক অর্থোপেডিক চিকিৎসকের দেখা পাই। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েই স্বপ্ন দেখতে থাকি অর্থোপেডিক সার্জন হব। তিনি এবং তাঁর মিসেস মেরি গাস্ট আমাকে ছেলের মতো স্নেহ করতেন। এরপর অর্থোপেডিক সাবজেক্টকে এগিয়ে নিতে বিদেশ থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করি। আমি ‘এ ও ট্রমা বাংলাদেশ’-এর সভাপতি হিসেবে একদল দক্ষ টিম দ্বারা বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ট্রমা ও অ্যাকসিডেন্টের ওপর ভলান্টিয়ারিং কাজ করে যাচ্ছি। জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট বা আর্থোপ্লাস্টি সার্জারিকে বিশ্বে সুপার স্পেশালাইজড সার্জারি বা সেন্টার বলা হয়। আমি মনে করি, একজন সিনিয়র কাউকে দায়িত্ব দিলেই জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট বা আর্থোপ্লাস্টি সার্জারিকে আরো এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এতে মানুষের আস্থা আরো বাড়বে।

কিছুদিন আগে আপনি বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি বিষয়ে তখন আপনার কী ভূমিকা ছিল?
ডা. এম আমজাদ হোসেন : যাঁরা জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জারির উদ্ভাবক এবং অভিজ্ঞ, আমি তাঁদের সেন্টারে কাজ করে এসেছি। নব্বইয়ের দশক থেকেই বিদেশের খ্যাতনামা সার্জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে আসছি। অর্থোপেডিক বিষয়ে বিশ্বে যত সোসাইটি আছে, আমি চেষ্টা করি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে এবং কনফারেন্সগুলোতে যোগ দিতে। বিদেশে গেলে জ্ঞানের পরিধি বাড়ে এবং ভালো কাজ করার মনমানসিকতা তৈরি হয়।

দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সভা, সিম্পোজিয়াম, ট্রেনিং ও লাইভ সার্জারির মাধ্যমে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। প্রশিক্ষিত হতে দেশের জুনিয়র চিকিৎসকদেরও দেশের বাইরে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছি। এখন বাংলাদেশের অনেক সেন্টারেই এ সার্জারি হচ্ছে এবং অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আরো এগিয়ে যাবে।

যোগাযোগের ঠিকানা
বাড়ি-১, রোড-৪
ধানমণ্ডি, ঢাকা-১২০৫
মোবাইল : ০১৭১৫২৫৩৪০৮ ০১৯৭০৭৮৬৯৭০
ই-মেইল : dramjadhossain@gmail.com
ওয়েবসাইট : www.arthroplastybd.com

অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন
চিফ কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান, অর্থোপেডিক ও আর্থোপ্লাস্টি সেন্টার, ল্যাবএইড হাসপাতাল লিমিটেড, ধানমণ্ডি, ঢাকা

 

পাঠকের মতামত

Comments are closed.