231684

খতম তারাবির ইমামতি করে বিনিময় বা হাদিয়া নেয়া জায়েয কি-না?

ডেস্ক রিপোর্ট : খতম তারাবির ইমামতি করে বিনিময় বা হাদিয়া নেয়া জায়েয কি-না? (২) এক মাসের জন্য ইমাম নিয়োগ দিয়ে বেতন দিলে জায়েজ হবে কি-না? (৩) কেউ কেউ বলেন, ফরজ নামাজের ইমামতির বিনিময় যখন জায়েজ তখন খতমে তারাবির বিনিময় গ্রহণও জায়েজ হবে। এছাড়া হাফেজ সাহেবকে যদি দু’এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজের দায়িত্ব দেয়া হয় তবে তো নাজায়েজ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাদের একথা ঠিক কি-না? (৪) ইমামতির হিলা (বাহানা) হোক বা অন্য কোনো উপায়ে তারাবির বিনিময় বৈধ কি-না?

উত্তর: তারাবির নামাজে কোরআন খতম করে বিনিময় দেওয়া-নেওয়া দুটোই নাজায়েজ। হাদিয়ার নামে দিলেও তা জায়েজ হবে না। এক মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে বেতন হিসাবে দিলেও জায়েজ নয়। কারণ, এক্ষেত্রেও প্রদেয় বেতন তারাবি এবং খতমের বিনিময় হওয়া স্বীকৃত। মোটকথা, খতমে তারাবির বিনিময় গ্রহণের জন্য বাহানা অবলম্বন করলেও তা জায়েজ হবে না। কেননা, খতমে তারাবি খালেস একটি ইবাদত। যা নামাজ ও রোজার মতো ‘ইবাদতে মাকসুদা’-এর অন্তর্ভুক্ত। আর এ ধরনের ইবাদতের বিনিময় বা বেতন দেয়া-নেয়া উম্মতে মুসলিমার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নাজায়েজ। এতে না কোনো মাজহাবের মতপার্থক্য আছে, না পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ফকিহগণের মাঝে কোনো মতভেদ আছে।

ইমামতির বেতন ঠিক করা এবং তা আদায় করা যদিও পরবর্তী ফকিহগণের দৃষ্টিতে জায়েজ কিন্তু খতমে তারাবির বিনিময়টা ইমামতির জন্য হয় না; বরং তা মূলত কোরআন খতমের বিনিময়ে হয়ে থাকে। আর তেলাওয়াতের বিনিময় গ্রহণ করা সকল ফকিহের নিকট হারাম। অধিকন্তু পরবর্তী ফকীহগণ যে ইমামতির বেতন জায়েজ বলেছেন সেটা হলো ফরজের ইমামতি। সুন্নত জামাতের ইমামতি এর অন্তর্ভুক্ত নয়। আর হাফেজদের দেয়া বিনিময়কে জায়েজ করার জন্য এই হিলা অবলম্বন করা যে, শুধু রমজান মাসের জন্য তার উপর দু’এক ওয়াক্ত নামাজের দায়িত্ব দেওয়া হবে-এটা একটা বাহানামাত্র; যা পরিহার করা জরুরি; এই হিলার যে বিনিময় তাকে ফরজের ইমামতির জন্য দেয়া হচ্ছে তার মানে কি সে তারাবির খতম বিনিময়হীনভাবেই করে দিচ্ছে! অথচ আপনার মনকে একটু প্রশ্ন করে দেখুন, যদি ওই হাফেজ সাহেব তার দায়িত্বে অর্পিত ফরজ নামাজের ইমামতি যথাযথ গুরুত্বের সাথেও আদায় করেন আর খতম তারাবিতে অংশগ্রহণ না করেন তবে কি তাঁকে ওই বিনিময় দেয়া হবে, যা খতম তারাবি পড়ালে দেয়া হয়?

এ কথা সুস্পষ্ট যে, কখনো তা দেয়া হবে না। তাহলে বুঝা গেল, বিনিময়টা মূলত তারাবিতে কোরআন খতমের; ফরজ নামাজের ইমামতির জন্য নয়। এ জন্যই আকাবির ওলামায়ে কেরামের অনেকে এই হিলা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর দলিলের ভিত্তিতেও তাদের ফতোয়াই সহি। (আরও দেখুন : ইমদাদুল ফতওয়া ১/৩২২; ইমদাদুল আহকাম ১/৬৬৪) মহান আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কেতাবকে গোপন করে এবং এর বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা তাদের উদরে আগুন ছাড়া কিছুই পুরে না। হাশরের দিন আল্লাহ তাদেরকে পবিত্র করবেন না, তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না। এরাই হচ্ছে সেই সমস্ত মানুষ যারা সঠিক পথের পরিবর্তে ভ্রান্ত পথ এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে। আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল (সুরা বাকারা-১৭৪)

অত্যন্ত সরল কথা, আল্লাহর আয়াতের বিনিময়ে অর্থগ্রহণ মানে আগুন ভক্ষণ। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমার আয়াতসমূহ সামান্যমূল্যে বিক্রি করো না এবং কেবল আমাকেই ভয় কর। আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে সত্যকে গোপন করো না।’ (সুরা বাকারা ৪১-৪২) পবিত্র কোরআনে ইসলামের যে কোনো কাজের বিনিময়ে অর্থগ্রহণ করাকে হারাম করা হয়েছে। যারা বিনিময় গ্রহণ করে তাদের পেছনে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘অনুসরণ করো তাদের, যারা বিনিময় নেয় না এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সুরা ইয়াছিন-২১)

দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তৃক প্রদত্ত ফতোয়াতেও আমরা দেখি, খতম তারাবির বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ নাজায়েজ। হজরত মুফতি আজিজুর রহমান (রহ.) বলেন, বিনিময় গ্রহণ করে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করা জায়েজ নেই। যাদের নিয়তে দেওয়া-নেওয়া আছে, তাও বিনিময়ের হুকুমে হবে। এমতাবস্থায় শুধু তারাবি আদায় করাই ভালো। বিনিময়ের কোরআন তেলাওয়াত না শোনা উত্তম। কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব শুধু তারাবি পড়লেই অর্জন হয়ে যাবে।’ (ফতোয়া দারুল উলুম ৪/২৪৬)

হজরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (র.) বলেছেন, তারাবিতে যে পবিত্র কোরআন পড়ে এবং যে শোনে তাদের মধ্যে অর্থের বিনিময় হারাম। (ফতোয়ায়ে রশীদিয়া- ৩৯২) বিনিময় নিয়ে তারাবি নামাজে ইমামতকারী ইমামের ব্যাপারে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুর রহমান মোবারকপুরী (রহ.) বলেন, আমি বিনিময় নিয়ে নামাজ পড়ানোকে মাকরূহ মনে করি এবং আমার ভয় হয়, ওই সব লোকের নামাজ আবার পড়তে হবে কি না, যারা এমন ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি বলেন, আমার মত হলো, বিনিময় গ্রহণ করা যাবে না। (ফতোয়ায়ে নজিরিয়া ১/৬৪২)

সারকথা হলো, কুরআন তেলাওয়াত বিশেষত যখন তা নামাজে পড়া হয়- তা একটি খালেস ইবাদত। যা একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া চাই। তাতে কোনো দুনিয়াবি উদ্দেশ্য শামিল করা গুনাহ। আজকাল তো অনেক মসজিদে তারাবির হাদিয়ার নামে চাঁদাবাজিও শুরু হয়ে গেছে।(নাউজুবিল্লাহ!) মসজিদ কমিটির লোকজন বাসায় বাসায় গিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ‘হাদিয়া’র জন্য চাপ প্রয়োগ করে। লজ্জায় কেউ কেউ ‘হাদিয়া’ দিয়ে দেয়। আবার কোথাও কোথাও অপমানিতও হতে হয় সাধারণ মুসলমানদের। অথচ হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে- ১. হযরত আবদুর রহমান ইবনে শিবলি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা.কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা কুরআন পড়ো তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না এবং তার প্রতি বিরূপ হয়ো না। কুরআনের বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা করো না।’ (মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৮; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৫/২৪০; কিতাবুত তারাবি)

২. ‘ইমরান ইবনে হোসাইন রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা.কে বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআন পড় এবং আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা কর। তোমাদের পরে এমন জাতি আসবে, যারা কুরআন পড়ে মানুষের কাছে (হাদিয়া) প্রার্থনা করবে।’ (মুসনাদে আহমদ ৪/৪৩৭; জামে তিরমিযী ২/১১৯৩)

৩. ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মা’কিল রা. থেকে বর্ণিত, তিনি এক রমজান মাসে লোকদের নিয়ে তারাবি পড়লেন। এরপর ঈদের দিন উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ রাহ. তাঁর কাছে এক জোড়া কাপড় এবং পাঁচশ দিরহাম পাঠালেন। তখন তিনি কাপড় জোড়া ও দিরহামগুলো এই বলে ফেরত দিলেন যে, আমরা কুরআনের বিনিময় গ্রহণ করি না।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৫/২৩৭আরো দেখুন : ফাতাওয়া শামী ৬/৫৭; তানকীহুল ফাতাওয়া হামীদিয়া ২/১৩৭-১৩৮; আল ইখতিয়ার লিতা’লীলিল মুখতার ২/৬২; শিফাউল আলীল ওয়াবাল্লুল গালীল (রাসায়েলে ইবনে ইবনে আবেদীন) ১/১৫৪-১৫৫; ইমদাদুল ফতওয়া ১/৩১৫-৩১৯)

পাঠকের মতামত

Comments are closed.