255456

হাত-পা নেই, মুখ দিয়ে ছবি এঁকে এমদাদুলের বাজিমাত

এমদাদুল মল্লিক ইব্রাহিমের দুই হাত নেই। হুইলচেয়ারে বসা দুই পা পুরোপুরি অবশ। তবে ইব্রাহিম মল্লিকের মাথা ও মুখ খুব ব্যস্ত। মুখে তুলি। ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার রং নিচ্ছেন আর ছবি আঁকছেন। হুইলচেয়ারের সঙ্গে বিশেষ উপায়ে লাগানো ক্যানভাসে গরু, গাছ, মানুষসহ বিভিন্ন জিনিসের ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার কারনে বিদ্যুতের খুটি থেকে পড়ে হারিয়েছেন দুই হাত আর সাথে পঙ্গু হয়েছে তার দুই পা। ঢাকার সাভারে অবস্থিত সিআরপি’তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিন মাসের প্রশিক্ষণে ছবি আঁকার প্রতি তার ভালোবাসার জন্ম হয়। বর্তমানে তিনি নিজ বাড়ির পুকুর পাড়ে বসে মুখের সাহায্যে পেন্সিল ও রঙ তুলি দিয়ে ছবি আঁকেন। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার পরানপুর ইউনিয়নের চককেশব (বালুবাজার) নিজ গ্রামে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বসবাস করছেন মাউত পেইন্টার এমদাদুল মল্লিক ইব্রাহিম।

সরকার কর্তৃক প্রতিবন্ধী ভাতা ও মায়ের বিধবা ভাতা দিয়ে কোনো রকমে চলছে তার জীবন সংসার। যদি কখনও সুযোগ হয় তবে তার প্রতিভাকে প্রদর্শনী আকারে তুলে ধরতে দৃঢ় প্রত্যয়ী তিনি। পাশাপাশি ছবি থেকে যা আয় হবে তা দিয়ে নিজের ও মায়ের দেখাশুনা চালিয়ে যেতে চান তিনি।

এমদাদুল মল্লিক ইব্রাহিম জানান, তার দুই হাত ছিল। পা সচল ছিল। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। কাজ করতেন দিনাজপুর পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান হিসেবে। ২০০৫ সালের ১৫ই ডিসেম্বর সব ওলট পালট হয়ে গেল। লাইনম্যান হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ঘটল দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় তিনি হারিয়ে ফেলেন তার দু’টি হাত। চিকিৎসার খরচ পল্লী বিদ্যুৎ নিলেও নেয়নি তার ভবিষ্যৎ জীবনের দায়িত্ব। তাই নিজ চেষ্টায় তিনি ছবি আঁকা শিখে নিজের কর্মকে সবার কাছে তুলে ধরেছেন।

দুর্ঘটনার পর স্থানীয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসা নেন আট বছর। মুখ দিয়ে ছবি আঁকা প্রসঙ্গে এমদাদুল বলেন, সিআরপিতে থাকা অবস্থায় সবার কাছে শুনেছেন লাভলী নামের একজন মুখ দিয়ে ছবি আঁকতেন। লাভলীর সঙ্গে তার কখনো দেখা হয়নি। লাভলীর গল্প শুনেই অনুপ্রেরণা। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে ছবি আঁকতে বসলে মাথা ঘুরত। বমি করতাম। পরে সব ঠিক হয়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবি আঁকতে পারতেন। বেশি ভালো লাগে প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে। তবে বর্তমানে বেশিক্ষন ছবি আঁকতে পারেন না তিনি। একটানা ছবি আঁকলে গায়ে জ্বর আসে। শরীরের সার্বিক পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নেই। গত চার বছর যাবত তিনি তার বৃদ্ধা মায়ের অসুস্থতার কারণে নিজ বাড়ি চককেশব বালুবাজারে আছেন। নিজ বাড়িতে থেকে তার মুখ দিয়ে অঙ্কনকৃত ছবি প্রদর্শনী অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই তিনি যদি সুযোগ পান তবে তার প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তার পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে চান।

আলাপকালে তিনি বেশ গর্ব নিয়েই জানালেন, সিআরপিতে থাকা অবস্থায় তার আঁকা ছবি দিয়ে অনেকগুলো প্রদর্শণী করেছেন। আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছিল। তাদের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল নিয়মিত। তাদের মাধ্যমেই তার ছবি আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি হয়েছে। ছবির দাম নিয়ে দেনদরবার তেমন একটা করা হয় না। বেশির ভাগ সময়ই একেকজন খুশি হয়ে যা দেন, তা-ই নেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তার কাছ থেকে ২০টি ছবি নিয়ে এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন, সে কথাও জানালেন।

পরানপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইলিয়াস খান জানান, তিনি মাউথ পেইন্টার এমদাদুল মল্লিক ইব্রাহিমকে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী কার্ড এবং তার মায়ের জন্য বিধবা ভাতাভোগী কার্ডের ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, উপজেলা ভিত্তিক ছবি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা না থাকায় ইব্রাহিমের প্রতিভাকে সে বিকশিত করতে সক্ষম হচ্ছে না । যদি বড় পর্যায়ে কখনো তার প্রতিভাকে দেখানোর সুযোগ পান তবে তিনি একদিন দেশের সম্পদ হয়ে উঠবেন।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম জানান, উপজেলা সমাজসেবা থেকে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হয়েছে তারপরও যদি তার ছবি আঁকাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকারী ঋণের মাধ্যমে তাকে সহযোগিতা করা হবে।

মান্দা উপজেলা প্রকল্প ব্যাস্তবায়ন কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, দুই হাত নেই তবুও তিনি মুখের সাহায্যে এঁকে চলেছেন বিভিন্ন রকমের ছবি। উপজেলা প্রশাসন থেকে তার ছবি প্রদর্শনীর ব্যাবস্থা করা হবে এবং তাকে সরকার কর্তৃক সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।

তার প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনেরা তার প্রতিভাকে দেখে মুগ্ধ। তিনি যখন ছবি আঁকেন তখন তার প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনরা তা মুগ্ধ হয়ে দেখেন। আর তার প্রতিভাকে সম্মান জানান তারা। মুখ দিয়ে ছবি আঁকা যে তার একটি বিশেষ গুণ তা তার ছবিগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়। তিনি জানেন তার প্রতিভাকে গ্রামে থেকে বিকশিত করা সম্ভব না। তবুও মাউথ পেইন্টার ইব্রাহীমের স্বপ্ন একদিন তিনি মুখ দিয়ে ছবি এঁকে পুরো বিশ্বের কাছে পরিচিতি লাভ করবেন।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.