259909

আধুনিকায়নের পর আজ খুলছে আন্তর্জাতিক মানের ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন

ডেস্ক রিপোর্ট  :  বছরজুড়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ‘বালিশকাণ্ড’ ও টেন্ডারবাণিজ্যর ঘটনায় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সবার ভেতর আতঙ্ক নেমে এলে সংস্থাটির উন্নয়নকাজে ব্যাঘাত ঘটে।

এই আতঙ্ক ও সমালোচনা পাশ কাটিয়ে আশার আলো দেখিয়েছে ‘ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের আধুনিকায়নের সংস্কার প্রকল্পের কাজ। নির্ধারিত সময়ের ৭ মাস আগে মিলনায়তনের সংস্কার কাজ শেষ করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাবনার রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে ‘বালিশকাণ্ড’ দুর্নীতি এবং যুবলীগ নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীমের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকায় গণপূর্তের বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় মন্ত্রণালয়। এরপর থেকেই প্রত্যেক কর্মকর্তার ভেতরে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।

সেই ভীতি কাটিয়ে তুলতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব এবং গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী জাঁকজমকভাবে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সংস্কার কাজ পরিদর্শন করেন।

জানা যায়, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিকায়নের জন্য চলতি বছরের মার্চ মাসে কাজ শুরু করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। প্রকল্পের মেয়াদ অনুযায়ী ২০২০ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের প্রায় সাত মাস আগে সংস্কার ও আধুনিকায়নের কাজ শেষ হয়েছে।

এখন মিলনায়তনের ভেতরের সৌন্দর্যের মতো বাইরের সৌন্দর্য বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে সংস্থাটি। সরেজমিন দেখা গেছে, প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় থেকে কয়েক গজ দূরে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন অবস্থিত।

যা মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীর নামে নামকরণ করা হয়। প্রায় চার দশকের পুরনো মিলনায়তন আন্তর্জাতিক মানে উপনীত করা হয়েছে। এখানে পরিশীলিত ও মনোরম পরিবেশ বিরাজমান।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় সিঙ্গাপুর থেকে আনা অ্যাকুয়েস্টিক ডিজাইন মিলনায়তনের সংস্কার করা হয়েছে। এতে প্রতিবন্ধীবান্ধব আসন ও প্রতিবন্ধীদের সুবিধার্থে হুইল চেয়ার বহনযোগ্য লিফট স্থাপন ছাড়াও অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, যুগোপযোগী অডিও আউটপুট, দৃষ্টিনন্দন লাইটিং, মিলনায়তনে একটি ভিভিআইপি অফিস ও দুটি কনফারেন্স রুম, নিরাপত্তা সিসিটিভি, নেটওয়ার্কিং ওয়াইফাই ও এলইডি স্ক্রিন স্থাপন করা হয়েছে। সামনে রয়েছে ফুলের বাগান।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ঢাকা সার্কেল-১) ও ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম সোহরাওয়ার্দী জয়যাত্রা.কমকে বলেন, মিলনায়তনের সংস্কার কাজের সময়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি, কাজের গুণগতমান নিশ্চিত করা হয়েছে।

এছাড়া গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় সংস্কার কাজ ৭ মাস আগে শেষ হয়েছে। এভাবে সব কর্তৃপক্ষ যদি সমন্বিতভাবে কাজ করে তাহলে সরকারি যেকোনো উন্নয়নকাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সংস্কার কাজের মাধ্যমে তা প্রমাণ হয়েছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জন্য এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। মিলনায়তনের সংস্কারের স্থায়িত্ব থাকবে আগামী ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত বলে মনে করেন এ প্রকৌশলী।

তিনি আরও বলেন, মিলনায়তনের সংস্কার কাজটি গণপূর্ত অধিদপ্তর সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বাস্তবায়ন করেছে। এখানে স্থাপত্য অধিদপ্তর কর্তৃক ভেটিংকৃত স্থাপত্য নকশা ব্যবহার করা হয়। মিলনায়তনকে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিকমানের করা হয়েছে।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (নগর গণপূর্ত বিভাগ) মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ জয়যাত্রা.কমকে বলেন, চব্বিশ ঘণ্টায় তিন শিফটে বিপুল জনবল দিয়ে কাজ করানো হয়েছে।

একদিনে সর্বোচ্চ ৩৭০ জন লোক কাজ করেছেন। এটি ব্যতিক্রমী কাজ হওয়ায় লোকবল সংগ্রহ করাও কঠিন ব্যাপার ছিল। এ ছাড়াও গণপূর্ত অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের আন্তরিকতার অভাব ছিল না। ফলে নির্ধারিত সময়ের ৭ মাস আগে সংস্কার কাজ শেষ করা হয়।

জানা গেছে, ব্যস্ততম ঢাকা শহরের সবচেয়ে নিরিবিলি মিলনায়তন এটি। এ কারণে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের সমাগম বেশি এখানে। সচিবালয় থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বের হয়েই সহজে যেকোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

এতে যাতায়াতে সময় যেমন বাঁচবে তেমনি যানজট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। মিলনায়তনটি গত ২১ নভেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম পরিদর্শন করেন।

পরিদর্শনকালে সম্পূর্ণ মিলনায়তন ঘুরে দেখেন ও এটি পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার জন্য কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।

ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন সংশ্লিষ্টরা জানায়, ১৯৮৫ সালে প্রথম সার্ক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন সংস্কার করা হয়েছিল।

এরপর আর কোনো সংস্কার হয়নি। জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকায় বিভিন্ন পোকামাকড় বাসা বেঁধে ছিল। নতুনভাবে সজ্জিত করায় মঞ্চের পাশাপাশি ৭২০টি আসন ফুটে উঠেছে। মিলনায়তনটি বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন।

ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন কাজের মূল ঠিকাদার বঙ্গ বিল্ডার্সের পরিচালক লিটন জয়যাত্রা.কমকে বলেন, সরকারের উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে পারে না। সেদিক থেকে আমরা মিলনায়তনের সংস্কার কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করতে পেরেছি। এটি আমাদের জন্য সুখবর।

ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সাব-ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে প্যারাডাইম আর্কিটেক্টস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আ ন ম খাইরুল আনোয়ার জয়যাত্রা.কমকে বলেন, এটির সংস্কার কাজ করার আগেই ডিজাইন পাস করেছি। কাজ করতে গিয়ে আর ডিজাইন সংশোধনের দরকার হয়নি, শুধু সংস্কার কাজ করি।

মিলনায়তনটি সচিবালয়ের পাশে হওয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে দ্রুত সংস্কারকাজ করেছি। এতে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলো তাড়াতাড়ি করা যাবে এবং সরকারের রাজস্ব বাড়বে।

তিনি বলেন, মিলনায়তনে প্রতিবন্ধীবান্ধব কোনো লিফট ছিল না। এবার প্রতিবন্ধীবান্ধব লিফট লাগানো হয়েছে। এতে একজন প্রতিবন্ধী অন্যের সহযোগিতা ছাড়াই লিফটে উঠে অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করতে পারবেন।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে— মিডিয়ার কাভারেজের জন্য সুব্যবস্থা রয়েছে। এখানে ক্যামেরার জন্য আর দীর্ঘ ক্যাবলের প্রয়োজন হবে না। খাইরুল আনোয়ার আরও বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে কাজের মাঝখানে ডিজাইন কয়েকবার সংশোধন করা হয়।

এতে কাজে ধীরগতির পাশাপাশি ব্যয় বাড়তে থাকে কিন্তু ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের কাজ করতে গিয়ে সেটির প্রয়োজন হয়নি। কারণ আমরা নিজেরাই প্রকৌশলী। ফলে প্রজেক্টে কনসালটেন্ট নিয়োগে সমস্যাও হয়নি।

প্যারাডাইম আর্কিটেক্টস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফয়সাল জয়যাত্রা.কমকে বলেন, ‘ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের আধুনিকায়ন’ প্রকল্পের সংস্কার বাজেট ৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আমরা টেন্ডারে কাজ করেছি ৩৫ কোটি টাকার। তবে নতুন নতুন বিষয় সংযুক্ত করলে প্রকল্পের পুরো অর্থ ব্যয় হবে।

তিনি আরও বলেন, মিলনায়তনে নতুন প্রযুক্তির মধ্যে যোগ হতে পারে ‘ফেস রিকগনিশন’ সিস্টেম। এতে মানুষের গতিবিধির ওপর নজর রাখা এবং দ্রুত শনাক্ত করা যাবে। ফেস রিকগনিশন সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচয়হীন মানুষকে সহজে শনাক্ত করা যাবে। আর সফটওয়্যারের মাধ্যমে পুলিশ কর্মকর্তারা সন্দেহভাজনদের তাৎক্ষণিক মিলিয়ে দেখতে পারবেন।

প্রসঙ্গত, কাজ শুরুর আগে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এবং স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি সরেজমিন ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন পরিদর্শন করেন।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.