261662

নাবল শহরে মানুষের চেয়ে বিড়ালের সংখ্যা বেশি!

ডেস্ক রিপোর্ট : যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার কাফর নাবল শহরে এখন মানুষের চেয়ে বিড়ালের সংখ্যাই বেশি। মাসের পর মাস সিরীয় ও রুশ সেনাদের বোমাবর্ষণের পর বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত কাফর নাবল এখন ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়ে গিয়েছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সাংবাদিক মাইকেল টমসন গিয়েছিলেন ভুতুড়ে নগরীটিতে। তিনি বলেন, ‘কঠিন এই দুঃসময়ে কাফর নাবলের অবশিষ্ট মানুষ এবং বিড়ালেরা পরস্পরকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে।’

তিনি যেদিন সেখানে ছিলেন, সেদিন আরেক দফা বোমা হামলা শুরু হয় শহরটিতে।

শহরের বাসিন্দা ৩২ বছরের সালাহ জার বাঁচার জন্য তার বাড়ির ইট-পাথরের টুকরো ভর্তি বেসমেন্টের কোনায় একটি টেবিলের নিচে আশ্রয় নেন । তার সঙ্গে একই টেবিলের তলে তাকে ঘিরে ছিল ৬-৭টি বিড়াল। সালাহর মতো তারাও ছিল আতঙ্কিত ও ভীত সন্ত্রস্ত।

সালাহ বললেন, ‘বিড়ালগুলো সঙ্গে থাকলে কিছুটা ভরসা পাই। বোমা যখন শুরু হয় ভয় যেন একটু কম লাগে।’

বিবিসি বাংলা জানায়, কাফর নাবলে একসময় ৪০ হাজার লোকের বসবাস ছিল। এখন সেই সংখ্যা কমতে কমতে বড় জোর ১০০। সেখানে এখন বিড়ালের সংখ্যা মানুষের চেয়ে অনেকগুণ বেশি।

শহরটিতে বিড়ালের সংখ্যা কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার বলে ধারণা করা হয়। সালাহ জানান, মানুষ আছে এমন প্রতিটি বাড়িতে এখন কমপক্ষে ১৫টি করে বিড়াল রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘খুবই কম মানুষ এখন এই শহরে। বিড়ালগুলোকে দেখাশোনা করার জন্য তো কিছু মানুষ দরকার। তাদের খাবার দিতে হয়, পানি দিতে হয়। সুতরাং যে সব বাড়িতে এখনো মানুষ রয়েছে, বিড়ালগুলো যেসব বাড়িতে গিয়ে ভিড় করছে।’

ফ্রেশ এফএম নামে স্থানীয় একটি রেডিও স্টেশনের রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন সালাহ। সম্প্রতি বোমায় রেডিও স্টেশনটির মূল স্টুডিওটি ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ট্রান্সমিটারটি তার কদিন আগে কাছের একটি শহরে সরিয়ে নেওয়া হয়।

এই রেডিও স্টেশন থেকে খবর, শ্রোতাদের সঙ্গে ফোন-ইন, কৌতুক অনুষ্ঠান প্রচারের পাশাপাশি বিমান হামলার আগাম বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

স্থানীয়দের কাছে এই রেডিও স্টেশনটি যেমন জনপ্রিয়, শহরের বিড়ালদের কাছেও তেমনই প্রিয়। বেশ কিছুদিন ধরেই কয়েক ডজন বিড়াল স্টেশনটির ভবনটিকে তাদের ঘর বানিয়েছে।

রেডিওটির প্রতিষ্ঠাতা রায়েদ ফারেসকে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ইসলামপন্থীরা হত্যা করে। কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি এই বিড়ালগুলোকে খাওয়ানোর জন্য কিছু পয়সা রেখে গিয়েছিলেন।

সালাহ বলেন, ‘অনেক বিড়ালের জন্ম হয়েছে এই ভবনে। সেগুলোর মধ্যে সাদা এবং বাদামি ছোপের একটি বিড়ালকে খুবই ভালোবাসতেন রায়েদ। তিনি যেখানে যেতেন, বিড়ালটি তার সঙ্গে থাকত। বিড়ালটিকে পাশে নিয়ে ঘুমাতেন তিনি।’

তার বিধ্বস্ত বাড়িটি থেকে সালাহ যখন বাইরে এলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে শুরু হয়ে যায় একগাদা বেড়ালের মিয়াও-মিয়াও ডাক। সব জায়গাতেই একই ঘটনা ঘটে।

সালাহ বলেন, ‘কখনো কখনো আমরা যখন রাস্তায় হাঁটি, ২০ থেকে ৩০টি বিড়াল আমাদের সঙ্গে হাঁটতে থাকে। তাদের কোনো কোনোটি আমাদের সঙ্গে বাড়িতে ঢুকে পড়ে।’

সন্ধ্যার পর এই শহরের নানা কোনা থেকে শোনা যায় কুকুরের ডাক। এরাও রাস্তাতেই থাকে। তাদের এখন আর ঘর নেই, ক্ষুধার্ত। ফলে রাতের বেলা শোয়ার জায়গা এবং খাবার নিয়ে শুরু হয়ে যায় রাস্তার বিড়াল এবং কুকুরদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি। আকৃতিতে ছোট ওই লড়াইতে সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত বিড়ালরাই জেতে।

সালাহ যদিও জানেন না, আগামীকাল তিনি বেঁচে থাকবেন কিনা। কাল তার খাবারের জোগাড় হবে কিনা, কিন্তু ঘরের বিড়ালগুলোর জন্য কিছু না কিছু তাকে জোগাড় করতেই হয়।

তিনি বলেন, ‘আমি যখনই খাই, ওরাও খায়। সেটা সবজি হোক, নুডলস হোক বা শুকনো রুটি হোক। আমি মনে করি আমাদের উভয়ের জন্য সময়টা অত্যন্ত খারাপ, আমরা উভয়েই দুর্বল হয়ে পড়েছি, সুতরাং আমাদের উচিত পরস্পরকে সাহায্য করা।’

বোমায় মানুষের পাশাপাশি বিড়ালগুলোও মাঝে-মধ্যেই জখম হয়। লোকজন তাদের চিকিৎসার সব রকম চেষ্টা করে।

সালাহ বলেন, ‘আমার এক বন্ধুর বাড়িতে একদিন বোমায় একটি বিড়ালের সামনের পায়ের থাবার কিছু অংশ উড়ে যায়। আমরা দ্রুত তাকে ইদলিবে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা দিয়েছিলাম। এখন সে হাঁটতে পারে।’

প্রেসিডেন্ট আসাদের সৈন্যরা কাফর নাবল থেকে বেশি দূর নয়। যে কোনো দিন হয়তো তারা এই শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। তখন এই বিড়ালগুলোর কী হবে – তা নিয়ে সালাহ উদ্বেগের মধ্যে থাকেন।

এই সিরীয় নাগরিক বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে আমাদের সু-সময়, দুঃসময় পার করছি। এক বিছানায় শুই। খাবার ভাগ করে খাচ্ছি। ওরা এখন আমাদের জীবনের অংশীদার হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘যদি তাকে এই শহর থেকে পালাতে হয়, তাহলে চেষ্টা করবেন সঙ্গে করে যতগুলো সম্ভব বিড়াল সঙ্গে নিয়ে যেতে।’

যুদ্ধের এই ভয়াবহতা আর বর্বরতার মধ্যে সিরিয়ার এই শহরে মানুষ এবং এই পশুগুলোর মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তা সহজে ভাঙার নয়।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.