262589

প্রশান্ত মহাসাগরে ১৪ মাস ভেসে বেঁচে ফিরলেন তিনি!

ডেস্ক রিপোর্ট : মাছ ধরার নেশায় তিনি বেরিয়ে পড়লেন সাগরে। তাও আবার ঝড় হওয়ার ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগেই। কতটা সাহসী তিনি ভাবা যায়! অতঃপর যা হওয়ার তাই হলেঅ অর্থাৎ ঝড়ে তিনি প্রশান্ত মহাসাগরে স্রোতে ভেসেই চললেন অজানা গন্তব্যে। তবে বিষ্ময়কর ঘটনাটি হলো মৃত্যুর কোল থেকে ৪৩৮ দিন অর্থাৎ ১৪ মাস পর বেঁচে ফিরেন এই সাহসী ব্যক্তি।
বলছি মেক্সিকোর এক মৎসজীবী সালভাদোর আলভারেঙ্গার কথা। ছোটবেলা থেকেই মাছ ধরার প্রতি আগ্রহ ছিল। আর এ নেশাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। ৩৭ বছর বয়সী সালভাদোর একজন মৎস্যজীবী ছিলেন। তিনি মেক্সিকোতে কাজ করতেন।

২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর সকাল দশটা। সালভাদোর আলভারেঙ্গা প্রশান্ত মহাসাগরে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য ছিল প্রচুর মাছ ধরে বিক্রি করার। কারণ পরবর্তী সাত দিন ঝড়ের পূর্বাভাস রয়েছে। তাই তিনি সমুদ্রে বের হতে পারবেন না। এজন্য যেভাবেই হোক সেদিনের মধ্যে সামনের সপ্তাহে চলার মতো অর্থ উপার্জন তাকে করতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ।

বেরিয়ে পড়লেন প্রশান্ত মহাসাগরে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাসাগর হলো প্রশান্ত মহাসাগর। পৃথিবীপৃষ্ঠের প্রায় এক তৃতীয়াংশই হলো এই মহাসাগরটি। যদি কেউ দক্ষিণ আমেরিকার চিলি থেকে পশ্চিমে যাত্রা করে পৃথিবীর অপর প্রান্তে পৌঁছায় তবুও দেখা যাবে তিনি প্রশান্ত মহাসাগরেই রয়েছেন। এই বিশাল মহাসাগরে অল্প কিছু সংখ্যক দ্বীপ থাকলেও তা বসবাসের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। আর এই প্রশান্ত মহাসাগরে হারিয়ে গিয়েও কিনা ৪৩৮ দিন অর্থাৎ ১৪ মাস পর বেঁচে ফিরেছেন সালভাদোর। কতই না রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছেন তিনি। জেনে নিন সেই গল্প-

মেক্সিকোর উপকূলীয় কোস্টা আজুল গ্রামে পরিবারসহ বসবাস করতেন এই মৎসজীবী। তিনি যেদিন মহাসাগরে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন সেদিন তার সঙ্গে চালক হিসেবে ছিলেন ২২ বছর বয়সী ইজিকিয়েল কর্দোবা। তাদের নৌকাটি অত্যন্ত ছোট ছিল। নৌকার পিছনে একটি ইঞ্জিন ও মাঝে মাছ রাখার জন্য একটি রেফ্রিজারেটর ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

তাদের লক্ষ্য ছিল ৩০ ঘণ্টার মধ্যেই তারা নৌকা ভর্তি করে মাছ সংগ্রহ করে তবেই বাড়ি ফিরবেন। যদিও তারা জানতেন যে দুই একদিনের মধ্যে একটি বিশাল ঝড় উপকূলে আঘাত হানতে চলেছে। তবে তারা সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে সাহস করে জলে নেমে পড়লেন। তাদের ধারণা ছিল, ঝড়ের পূর্বেই তারা ঘরে ফিরতে পারবেন। এভাবেই সেদিন তারা সমূদ্রের উপকূল থেকে প্রায় ১২০ কি.মি. দূরে চলে যান মাছ ধরার আশায়।

তখন রাত একটা। হঠাৎই আকাশ কেঁপে উঠল। তুমুল ঝড় উঠেছে সমুদ্রে। দিশেহারা হয়ে পড়লেন তারা দু’জনেই। এদিকে ছোট্ট এই নৌকাটি প্রায় ডুবতে বসেছে। সালভাদোর কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। অতঃপর নৌকা রক্ষায় তারা মাছ ধরার জাল ও প্রায় ৫০০ কেজি মাছ যা তারা এতোক্ষণ ধরেছিলেন সব ফেলে দিলেন। এরপর তারা সমুদ্রের উপকূলে ফিরে আসার চেষ্টা চালায়। ঠিক সকাল সাতটার সময় তারা তীর থেকে মাত্র ২৪ কি.মি. দূরে ছিল।

আর তখনই তারা লক্ষ্য করে তাদের নৌকার ইঞ্জিন থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। দেখা দিল আরেক সমস্যা, ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল। তখন স্রোতের দিকে অর্থাৎ সামুদ্রিক ঝড় বরাবর ভেসে যেতে থাকে তাদের নৌকাটি। তবে তাদের নৌকায় থাকা রেডিওটি তখনও কাজ করছিল। রেডিওর মাধ্যমে তাদের মালিককে তারা কোথায় আছেন সে খবরটি জানানোর চেষ্টা করেন। ঠিক এমন সময় রেডিওর ব্যাটারিও শেষ হয়ে যায়। প্রকৃতির এই নির্মমতায় তারা এবার সব আশা ছেড়ে দেয়। এবার বুঝি মরতেই হবে!

তারা সমুদ্রের মাঝ বরাবর যেতে থাকেন। এদিকে তাদের মালিক টানা দুই দিন ধরে টহলের মাধ্যমে তাদের খোঁজার চেষ্টা করেও হদিস পায়নি। কারণ তাদের নৌকা যে স্রোতের কবলে পড়ে ধীরে ধীরে প্রশান্ত মহাসাগরের আরো মাঝে চলেই যাচ্ছিল। ঘটনার পাঁচদিন পর সামুদ্রিক ঝড়টি থেমে যায়। তখন তাদের নৌকাটি তীর থেকে প্রায় ৪৫০ কি.মি. দূরে। তারা চারপাশে শুধু পানি আর পানিই দেখছিল। আর তাদের নৌকাটি এতোই ছোট ছিল যে প্লেন থেকে দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও তা দেখা যাওয়ার কথা নয়। এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে তারা বাড়ি ফেরার আশা ছেড়েই দেয়।

দিনের বেলা সূর্যের খরতাপে তারা ছটফট শুরু করত। সালভাদোর তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা রোদের তাপে প্রায় সিদ্ধ হয়ে যেতাম। আর রাত হলেও প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আইসবক্সের ভিতরে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করতাম। অনাহারের কষ্টে মনে হতো ঝাপিয়ে পড়ে পানিতে ডুবে মরে যায়। আর সমুদের সব পানি পান করব এমন তেষ্টা পেত কিন্তু সে পানি তো পান করলেই তো আরো বিপদ। আমি এতই ক্ষুধার্ত ছিলাম যে নিজের নখগুলো কামড়ে থেকে শুরু করি।

এদিকে খাবার নেই। খিদের জ্বালায় ছোট ছোট পাখি ও মাছ ধরে কাঁচাই খাচ্ছিলেন সালভাদোর ও তার বন্ধু। খাবার পানির সংকট তাদেরকে আরো দুর্বল করে দেয়। বাধ্য হয়ে তারা সমুদ্রে ভেসে থাকা প্লাস্টিকের বোতলে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে পান করছিলেন। আর বৃষ্টি না হলে তারা কচ্ছপের রক্ত ও নিজেদের প্রস্রাব পান করেই জীবন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এভাবেই দিনের পর দিন তারা কাটাতে থাকে। এক নৌকাই এখন তাদের অবলম্বন।

সালভাদোর বাড়ি ফিরবেন এই বিষয়ে সামান্য আশাবাদী থাকলেও তার বন্ধু কর্দোবা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। দিনের পর দিন আজেবাজে খাবার খেতে খেতে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। এমনকি খাওয়াও ছেড়ে দেয় কর্দোবা। এই নিঃসঙ্গ যাত্রার চার মাসের মধ্যেই কর্দোবা মারা যান। সালভাদোর এরপর একেবারেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এদিকে তিনি যেখানে ছিলেন সেদিক দিয়ে কোনো জাহাজও চলাচল করত না।

সৌভাগ্যবশত একদিন তিনি লক্ষ্য করলেন একটি কার্গো জাহাজ তার নৌকার বেশ কাছ দিয়ে যাচ্ছে। সালভাদোর তো খুশিতে আত্মহারা পড়েন। তবে সেই জাহাজে থাকা চারজন ব্যক্তি তাকে দেখে সাহায্য না করে বরং হাত নাড়িয়ে চলে যায়। এরপর ধীরে ধীরে ১৪ মাস কেটে যায়। তার নৌকাটি এরই মধ্যে এক হাজার কি.মি. অতিক্রম করেছে।

একদিন হঠাৎই সালভাদোর দেখতে পেলেন তার নৌকার আশেপাশে ডাব ভেসে যাচ্ছে। তখনই সে ভাবল, হয়ত আশেপাশেই কোন দ্বীপ রয়েছে। এর ১২ ঘণ্টা পর ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ সালে সে নিকটবর্তী একটি দ্বীপে সাঁতার কেটে উঠে আসে। অর্থাৎ নৌকায় ৪৩৮ দিন কাটানোর পর অবশেষে সে মাটিতে পা রাখল। এই দ্বিপটি মার্শল আইল্যান্ডের একটি ছোট্ট দ্বীপ ছিল। সেখানে সে কিছু আদিবাসীদের দেখেন।

তাদের কাছে পুরো ঘটনা বলার পর দ্বীপের বাসিন্দারা তার প্রাণ বাঁচায়। তারাই সালভাদোরকে মক্সিকোতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সেখানে পৌঁছে তিনি টানা ১১ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হলেও তার শরীরে রক্তসল্পতা দেখা দেয়। এছাড়াও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন সালভাদোর। ২০১৫ সালে তিনি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকারে তার সমুদ্রে টিকে থাকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন।

এর উপর ভিত্তি করেই লেখা হয় ‘৪৩৮ ডে’স: অ্যান এক্সট্রাঅর্ডিনারি ট্রু স্টোরি অব সার্ভাইবাল এট সি’। এই বইটি প্রকাশের পরপরই তার জীবনে ঘটে যায় আরো একটি ঘটনা। তার বন্ধু কর্দোবার পরিবার তার নামে মামলা করেন। তাদের ধারণা সালভাদোর তার বন্ধু কর্দোবাকে হত্যা করে মাংস খেয়েছে। এই বলে এক লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে কর্দোবার পরিবার। তবে সালভাদোর বরাবরই এই ঘটনাটি অস্বীকার করেন।

সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট

পাঠকের মতামত

Comments are closed.