262618

জিকে শামীমের টেন্ডার চক্রেও রয়েছে পাপিয়ার হাত

ডেস্ক রিপোর্ট : ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতারের পর জি কে শামীমের কাছ থেকেই প্রথম নরসিংদী যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়ার নাম জানতে পারে র‌্যাব।

শতশত কোটি টাকার টেন্ডার পাইয়ে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কীভাবে পাপিয়া ম্যানেজ করতেন, বিনিময়ে পাপিয়া কত পার্সেন্ট নিতেন- র‌্যাব কর্মকর্তাদের কাছে তা-ও ফাঁস করেছিলেন জিকে শামীম। মূলত তখন থেকেই পাপিয়াকে গোয়েন্দা নজরদারিতে আনা হয়। র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের সদস্যরা গোপনে অনুসরণ করতে থাকেন পাপিয়াকে।

কাদের সঙ্গে পাপিয়ার ঘনিষ্ঠতা, টেন্ডারবাজিসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে কারা তাকে সহায়তা করছে, এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে র‌্যাব। তবে অনুসন্ধানে যাদের নাম আসতে থাকে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ তো দূরের কথা, অনুসন্ধান করতেও সাহস করেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

দিকে রোববার আদালতে দেয়া পুলিশের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাপিয়া পাঁচতারকা হোটেল ওয়েস্টিনেই ৫১ দিনে ২ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। এর মধ্যে বারের বিলই ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, পাপিয়ার উত্থান এবং তার জীবনের গল্প আরব্য উপন্যাসকেও হার মানায়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পাপিয়া ও তার সহযোগীদের ব্যাপারে যখন অনুসন্ধান চলছিল, ঠিক ওই মুহূর্তে ব্ল্যাকমেইলের শিকার এক ব্যবসায়ীর সন্ধান পাওয়া যায়। ধনাঢ্য ওই ব্যবসায়ী র‌্যাবকে জানান, বড় ধরনের একটি টেন্ডার পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ওই ব্যবসায়ীকে রাজধানীর অভিজাত একটি হোটেলে ডেকে নেন পাপিয়া। সেখানে যাওয়ার পর জোর করে সুন্দরী এক মডেলের সঙ্গে ওই ব্যবসায়ীর আপত্তিকর ছবি তোলেন পাপিয়া এবং তার সহযোগীরা। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই ছবি ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলে পাপিয়া ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

র‌্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা বলেন, ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর পাপিয়া ও তার সহযোগীদের একটি প্রোফাইল তৈরি করা হয়। পরে ওই প্রেফাইলটি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দাখিল করা হয়।

র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রোফাইলে পাপিয়ার অনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডের বিবরণ ছাড়াও পাপিয়াকে সহায়তাকারীদের নাম ছিল। পরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে পাপিয়াকে গ্রেফতারে মাঠে নামে র‌্যাব। তবে আগেই এই খবর পৌঁছে যায় পাপিয়ার কাছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতার খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকা এক কর্মকর্তা পাপিয়াকে ভয়াবহ এ বিপদের খবর দিয়ে দ্রুত দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেন। এ খবর পাওয়ার পরপরই স্বামী মফিজুর রহমান সুমন ও দুই সহযোগীকে নিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি তড়িঘড়ি করে থাইল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন পাপিয়া ওরফে পিউ। তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় দীর্ঘদিন পাপিয়া ও তার সহযোগীদের অনুসরণ করা র‌্যাবের ওই দলটি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই পাপিয়া, তার স্বামী মফিজুর রহমান সুমন এবং দুই সহযোগী সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

র‌্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা বলেন, পাপিয়া ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে রাশিয়ান ১০ সুন্দরী মডেলকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানান। মূলত পাপিয়া তার সহায়তাকারীদের মনোরঞ্জনের জন্য রুশ ওই তরুণীদের ঢাকায় আনেন। তবে এতে বাদ সাধেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশে আগমনের সুনির্দিষ্ট কারণ জানাতে না পারায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দিতে রাজি হয়নি। পরে শীর্ষ ওই কর্মকর্তা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে ফোন করে রুশ তরুণীদের প্রবেশে বাধা না দেয়ার জন্য বলেন। পরে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। কিন্তু ততক্ষণে বিমানবন্দরে কর্তব্যরত সব সংস্থা বিষয়টি জেনে যাওয়ায় এবং ওই কর্মকর্তাকে নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এ তথ্য পৌঁছে গেলে ওই কর্মকর্তা অসুস্থতার দোহাই দিয়ে পরবর্তী কয়েকদিন অফিসে যাননি।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘পাপিয়ার বিদেশ থেকে মডেল আনার খবর আমরাও শুনেছি। তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি না। আমরা এই মামলার তদন্তভার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। তদন্তের দায়িত্ব পেলে আমরা সব ব্যাপারেই বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।’ হঠাৎ কেন পাপিয়াকে গ্রেফতার করা হল- এমন প্রশ্নে সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘আমাদের কাছে তার বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলসহ নানা ধরনের অভিযোগ ছিল। আমাদের গোয়েন্দারা তার ব্যাপারে বিস্তারিত জেনেছে। এরপরই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’

পাপিয়ার দুই সহযোগী ফের ৫ দিনের রিমান্ডে : রিপোর্টার জানায়, এদিকে রোববার ঢাকা মহানগর হাকিম দিদার হোসাইনের আদালতে পুলিশ যে প্রতিবেদন দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে, পাপিয়া সহযোগীদের নিয়ে ওয়েস্টিনের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে ৫১ দিন থাকেন। প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ টাকা ভাড়া এ স্যুটের। এছাড়া ওয়েস্টিনের আরও দুটি রুম ভাড়া নেন তিনি। সব মিলিয়ে পাপিয়া হোটেল বিল বাবদ দুই কোটি আট লাখ ৯২ হাজার ৮৮৭ টাকা ব্যয় করেন। এর মধ্যে বারের বিলই তার ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এদিন বিমানবন্দর থানার বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় পাপিয়ার দুই সহযোগীর ফের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। ঢাকা মহানগর হাকিম দিদার হোসাইন তাদের রিমান্ডে পাঠান। এরা হলেন- সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবা নূর।

প্রথম দফায় ৫ দিনের রিমান্ড শেষে রোববার তাদের আদালতে হাজির করে ফের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম। আবেদনে বলা হয়, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তারা সংঘবদ্ধ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তারা মাদক, অস্ত্র, চোরাচালান, অর্থের বিনিময়ে জমি দখল বেদখল ও অনৈতিক ব্যবসাসহ নানাবিধ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিকও হয়েছে।

আসামিরা পাপিয়া ও তার স্বামীর সহযোগিতায় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসচ্ছল ও স্বল্প শিক্ষিত নারীদের প্রলোভনের মাধ্যমে সংগ্রহ করত এবং তাদের দিয়ে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও এদের ব্যবহার করে তদবির বাণিজ্য করত।

তারা ওয়েস্টিনে গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ২০ দিন এবং চলতি বছরে ৫ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি মোট ৫১ দিন ওই হোটেলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটসহ আরও দুটি রুম ভাড়া নিয়ে অবস্থান করে। ওই রুমের প্রতিদিনের ভাড়া প্রায় আড়াই লাখ টাকা। ভাড়া বাবদ আসামিরা গত বছর ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৭ টাকা ও চলতি বছর ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করে। ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বারের বিলসহ আসামিরা ওই হোটেলের ভাড়া বাবদ মোট ২ কোটি ৮ লাখ ৯২ হাজার ৮৮৭ টাকা ব্যয় করে। মামলার ঘটনার বিষয়ে আসামিদের আরও নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেছিলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি পাপিয়া ও তার স্বামীসহ এ দুই সহযোগীর এই মামলায় ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। মামলায় পাপিয়া ও তার স্বামীর রিমান্ড শেষ হলেও শেরেবাংলা নগর থানার অপর দুই মামলায় পাপিয়া ও তার স্বামীর আরও ১০ দিনের রিমান্ড চলছে।

প্রসঙ্গত, ২২ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে থাইল্যান্ডে পাড়ি জমানোর সময় পাপিয়া ও স্বামীসহ চারজনকে আটক করে র‌্যাব-১।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে র‌্যাব সদস্যরা ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে পাপিয়া-মফিজুরের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ, পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি চেক বই, বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি এটিএম কার্ড উদ্ধার করেন। এ সময় অবৈধ একটি বিদেশি পিস্তল এবং দুটি ম্যাগজিনে ২০ রাউন্ড গুলিও উদ্ধার করেন র‌্যাব সদস্যরা। এ ব্যাপারে পৃথক তিন মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পিউ দম্পতি ছাড়াও তাদের দুই সঙ্গী বর্তমানে ১৫ দিনের পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। সূত্র : যুগান্তর

পাঠকের মতামত

Comments are closed.