268815

বিশ্বের প্রথম ‘পাত্র-পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন কেমন ছিল?

ছেলে-মেয়ের বিয়ের সময় হলে এখন আর ঘটক পাখি ভাইয়ের দেখা পান না অভিভাবকরা। এখন পাখি ভাইয়ের বিকল্প অনেক। অনলাইনেই অনেকে খুঁজে নেন জীবন সঙ্গীকে। ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটের ভিড় করেন। এখন গ্রামেগঞ্জেও দেখা না ছাতা হাতে মুখে দাঁড়ির হাসিখুশি ঘটকদের। তবে খবরের কাগজে আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, একটা জিনিস সবসময়ই থাকবে তা হলো, পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন।

কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই পছন্দের পাত্র-পাত্রী খুঁজে নেন। তবে ১৫০ বছর আগে পরিস্থিতি এতটা সহনশীল ছিল না। বাংলা খবরের কাগজে যখন প্রথম এই বিজ্ঞাপন দেয়া হয় তখন কিন্তু বঙ্গসমাজ এটি মেনে নেয় নিতে পারেনি একেবারেই। সর্বপ্রথম বাংলায় বিয়ের বিজ্ঞাপনের ধরণ যেমন ছিল-

“একজন কর্মচারী যিনি ২০ বছর কর্মকার্য করিয়াছেন, এখন তাহার বিবাহ করিবার ইচ্ছা হইয়াছে তিনি এমন একটি কনে চান যাহার বয়স ২৫ বৎসরের অধিক নহে এবং সংসারের কাজকর্মে বিশেষ নিপুণ। টাকাকড়ির প্রয়োজন নাই। বর বেশ সুখে স্বচ্ছন্দে আছেন। কনেরা দরখাস্তের সঙ্গে যেন নিজ নিজ চেহারার ছবি পাঠাইয়া দেন। যাঁহার চেহারা পছন্দ না হইবে তাহার চেহারা (ছবি) ফিরাইয়া দেওয়া যাইবেক। কনেরা ও কে নামে শিরোনাম দিয়া, এক্সচেঞ্জ গেজেট ছাপখানায় অধ্যক্ষের নিকট দরখাস্ত পাঠাইয়া দিবেন।”

দিনটি ছিল ১৮৭১ সালের ১১ জুলাই। ১৯ শতকের কথা। আর ঠিক তখনই এক বঙ্গসন্তান করে বসলেন এক আশ্চর্য কাজ। সংবাদপত্রে বিয়ের বিজ্ঞাপন দিলেন। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিয়ে হতে পারে একথা তখন মানুষের ভাবনার অতীত। তৎকালীন বাংলার একটি সংবাদপত্র এক্সচেঞ্জ গেজেট এ বেরোল একটি বিশেষ বিজ্ঞাপন। বিবাহ শিরোনামের ওই বিজ্ঞাপনটি ছিল এইরকমই। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে দেখলে, এটিই ছিল বাংলা সংবাদপত্রের প্রথম পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন।

বিয়ে

বিয়ে

এটি দেখে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় বাংলায়। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে যে বিয়ে করা যায়, এমন ঘটনায় রক্ষণশীল সমাজও জেগে উঠল। তারা ভাবতে লাগলেন এ কি অনাচার! শহর জুড়ে কানা ঘুষো তো ছিলই, পাশাপাশি সেই আগুনেও ঘি ঢালে সাময়িক পত্রিকাগুলো। এমনকি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় অন্যান্য কাগজের সম্পাদকদের কাছ থেকেও।

সেসময়কার সুলভ সমাচার পত্রিকার পক্ষ থেকে বলা হয়- “খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়া লোকে তো ঘর বাড়ি গাড়ি ঘোড়াই কিনিয়া থাকে, কিন্তু বিজ্ঞাপন দিয়া কিরূপে বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইতে পারে, আমরা তো তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কন্যাটি কেমন ঘরের মেয়ে, উহার চরিত্র কিরূপ, কেবল একখানা দরখাস্ত পড়িয়া যে কিরূপে এই সমস্ত অবগত হওয়া যায় এবং কিরূপেই বা এই সমস্ত গুরুতর বিষয় বিশ্বাস করিতে পারা যায়, বাঙ্গালির বুদ্ধিতে ইহা ঘটিয়া ওঠা দায়। ছি ছি লজ্জার কথা, দরখাস্ত করিয়া একজন কুলকামিনী অপর একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে পতিত্বে বরণ করিবে? এমন বিবাহের চেয়ে যাবজ্জীবন আইবুড়ো থাকা ভাল।”

ঘটকালি পেশার প্রতি পত্রিকার নীরব পক্ষপাতিত্ব দেখলে চমকে উঠতে হয়। কারণ সুলভ সমাচার এখানেই থামেনি। রীতিমতো সমাজকে, পাত্র-পাত্রীদের প্রচুর জ্ঞান দিয়েছে। সাহেবদের মধ্যে কন্যার বর মনোনীত করিবার ভার পিতামাতার উপর নির্ভর করে না। পিতামাতা পরামর্শ দেন বটে, কিন্তু কন্যাকে যে তাহা শিরোধার্য করিতে হইবে, এমন কোনও কথা নাই। এই দোষেই তাঁহাদের অনেক ভদ্র ঘরের মেয়ে অপাত্রে পড়ে। এই দোষেই অনেক স্ত্রীলোক চিরদুঃখে কাল কাটায়।” এটি ছিল সংবাদপত্রে বিবাহের বিজ্ঞাপন বিষয়। বক্তব্য এসে দাঁড়াল ছেলেমেয়েদের নিজেদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনে অধিকারে। এই ছিল ১৯ শতকের সমাজের বিচিত্র চিত্রমালা।

১৮৭১ সালের সেই বিজ্ঞাপন তখনকার প্রচলিত অনেক ধারণাকেই ভেঙে দিয়েছিল। তখন হয়ত অনেকেই এই ব্যাপারটি মানতে চাননি এই ঘটনা। তবে পরবর্তীকালে এই খবরের কাগজই পাত্র-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের অন্যতম একটি জায়গা হয়ে ওঠে। এখনকার প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে অন্যান্য মাধ্যমও উঠে এসেছে। শুরুটা যেমনই হোক না কেন! কাগজের সেই সনাতন পদ্ধতি কিন্তু আজো সমানভাবে চলে আসছে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.