183697

যে ভুলগুলি হয় রমজানে

জামাল হোসেন: মাহে রামাযান মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মানুষ এবং জিন জাতীর জন্য একটি বরকতময় মাস। বছরের বাকি ১১ মাস থেকে রামাযান মাসের মর্যাদা অনেক বেশি। আল্লাহ্‌ এই মাসকে খুব ভালোবাসেন। এই মাসে আল্লাহ্‌ নেয়ামতের সকল দরজা খোলা হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হয়। এই মাসে মানুষ যাতে তাঁর রবের কাছ থেকে রহমত, করুণা ও মাগফিরাত লাভ করতে পারে সে চেষ্টায় ব্যাস্ত থাকে।

মুসলিমের পাঁচটি মূল স্তম্ভের তৃতীয় হল সিয়াম বা রামাযান মাসের রোজা। নামাজের পর পর সিয়ামের স্থান। তাই এর গুরুত্ব ও অনেক বেশি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, আমরা এখনো রামাযান সম্পর্কে অনেক কিছু জানিনা বা জানার চেষ্টা ও করি না। আমাদের সমাজে এবং সামাজিকতার মাঝে অনেক ভুল ধারনা আজ এই সিয়াম এবং রামাযান মাসনিয়ে। এই অজ্ঞতার কারনে অলসতার কারনে আমাদের সিয়াম সুদ্ধ হয় না। বেশির ভাগ মুসলিম সিয়াম পালন করেন কিন্তু তাদের দেখে বুঝা যায় না যে তারা আল্লাহ্‌ অনুগত্ত করছে নাকি শয়তানের। এই সব লোকের মাঝে ভালো জান্নাতির কাজ করার ইচ্ছা কম। তাই অনেক সময় এই সব লোকের কর্ম কাণ্ড দেখে শয়তান ও লজ্জা পায়। আজ আমরা রামাজানের এই সব বিষয় নিয়ে আলচনা করব যা মানুষ সাধারণত শরিয়ত বিরোধী কাজ করে থাকে এই রামাযান মাসে।

(১) রাতে জাগা ও দিনে ঘুমানো: অনেক মুসলিম আছেন যারা রামাযান মাসে রাতে জাগেন আর দিনে ঘুমান। এই অভ্যাসের কারনে মানুষ অনেক কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হন। এর কারনে অনেক সময় জামাতে নামাজ ছুতে যায় বা নামাজের সময় চলে যায়।

(২) রামাযান মাসে খাদ্য ও খানাপিনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা: সিয়ামের মাসে মানুষ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির সাথে সাথে ক্ষুধার যে জালা তা অনুভব করে, যাতে সমাজের গরিব দুঃখী মানুষের ক্ষুধা ও কষ্টের বাস্তবতাকে অনুভব করা যায়। কিন্তু অনেক মুসলমান আছেন যারা নিজেদের খানাপিনা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে যা রামাযানের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।

(৩) আগে আগে সাহুর খেয়ে ফেলা: অনেকে আছেন যারা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে পড়ে বার’টা বা এক’টায় খানা খেয়ে শুয়ে পড়ে। এটা করা একদম ঠিক না কারণ শেষ রাতে সাহুর খাওয়া সুন্নাত, তাই সে আগে সাহুর খেয়ে সুন্নাতের বিপরীতে কাজ করল এং সাহুরের যে বরকত তা থেকে বঞ্ছিত হল। আর যদি ফজর সালাত ছুটে যায় তবেত বড় গুনা হবে।

রাসুল (সঃ) বলেন, “তোমরা সাহুর খাও কারন সাহুরে বরকত রয়েছে”। (বুখারী, মুসলিম)
অন্য আর একটি হাদিসে নবী (সঃ) বলেন, “ আমাদের ও আহলুল কিতাব (ইহুদি-খ্রিস্টানদের) ছিয়ামের মাঝে পার্থক্য হল সাহুর খাওয়া”। এর মানে হল আহলুল কিতাবিরা ছিয়াম পালন করে সাহুর না খেয়ে আর আমরা ছিয়াম পালন করি সাহুর খেয়ে। (মুসলিম হাদিস নং- ১০৯৬, তিরমিযী হাদিস নং- ৭০৮)

(৪) ইফতারিতে দেরি করা: অনেকে সূর্য ডুবে জাবার পরও সতর্কতার অজুহাতে দেরি করে ইফতার করে। এটা সম্পূর্ণ সুন্নার বিপরীত একটি কাজ। নবী (সঃ) যে কাজটি যে ভাবে করতে বলেছেন সেভাবে না করে অন্য ভাবে করা। এটি শয়তানের ওয়াসওয়াসার অনুকরণ।

রাসুল (সঃ) বলেন, “ততদিন যাবত আমার উম্মাত কল্যাণের মাঝে থাকবে যতদিন আগেভাগে (সূর্য ডুবার সাথে সাথে) ইফতার করবে”। (সহীহ বুখারী)
(৫) অসৎ কাজ ও খারাপ ব্যাবহার করা: রামাযান মাসে অনেক জাগায় দেখা যায় অনেক রোজাদার অসৎ কাজে লিপ্ত হয় খারাপ ব্যাবহার করে মিথ্যা কথা ও গীবত করে। যা একজন রোজাদারের জন্য একদম খারাপ এবং সিয়ামের বিপরীত কাজ। এতে তাঁর সিয়ামের ছওয়াব নষ্ট হয়ে যায়।

নবী (সঃ) বলেছেন, “যখন তোমাদের কারো ছিয়ামের দিন উপস্থিত হয় তখন সে যেন কোন অশ্লীল কথা ও কাজ না করে এবং অহেতুক উচ্চস্বরে কথা না বলে অর্থাৎ ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেও তাকে গালি দেয় বা তাঁর সহিত লড়াই ঝগড়া করতে আসে তবে সে যেন তাকে বলে দেয়, আমি রোজা আছি”। (বুখারী, মুসলিম)

(৬) সিয়ামের ফজিলত ও নিয়ম কানুন সম্পর্কে অজ্ঞতা: আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল অজ্ঞতা। সিয়ামের ফজিলত ও নিয়ম কানুন না জেনে তা পালন করা, সিয়াম পালন করা অবস্থায় কি করতে হবে এবং কি করতে হবে না, কি করলে ছিয়াম হালকা হয়, কি করলে ছিয়াম নষ্ট হয়, এই মাসে কোন কাজ আল্লাহ্‌ পছন্দ করেন না এই সব সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন না বা রাখার চেষ্টা ও কোরেন না।

(৭) মুখে উচ্চ স্বরে নিয়ত করা: এই ভুলটি আমাদের দেশে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আমাদের মধ্যে শতকরা ৯৮ জন মুখে উচ্চ স্বরে নিয়ত করে যা সম্পূর্ণ বিদাত, যা নবী (সঃ) কখন করেননি বা সাহাবা (রঃ) কেও করেননি। মূলত নিয়ত করতে হবে মনে মনে। মনে সংকল্প করাটাই নিয়ত। কেননা রাসুল (সঃ) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি (প্রথম) ফরজের পূর্বে নিয়ত করবে না তাঁর সিয়াম হবে না”। (নাসাঈ)

নিয়্যাত আরবি শব্দ, এর অর্থ হল সংকল্প করা বা মনে মনে কিছুর ইচ্ছে করা। এটা অন্তরের কাজ মুখের নয়। (লিসানুল আরব, ১৮ খণ্ড ৩৪৩ পৃষ্ঠা)
(৮) তারাবীহ সালাত আদায় না করা: অনেকে আছেন তারাবীহ এর সালাত আদায় করেন না। তারা তারাবীহ না পড়ে টিভি দেখা, গান শুনা, নাটক, সিনেমা দেখা এবং অনর্থক খেলা খেলে সময় নষ্ট করা যা বড় ধতনের পাপ বা অপরাধ।

(৯) রামাযানের শেষের দিকে অলসতা: রামাযান শুরুর সময় খুব গুরুত্বের সাথে পালন করে এর রামাযান শেষের দিকে অলস হয়ে পড়ে। যা মতেও উচিৎ নয়। এতে বুঝা যায় যে এই সকল মানুষের এই রহমতের মাসের রহমত নিতে বার্থ হয়েছে।

(১০) রামাযান শেষ সালাত শেষ: এটা বেশির ভাগের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। রামাযান শুরুর সাথে সাথে নামাজি হয়ে উঠে কিন্তু রামাযান শেষের সাথে সাথে সালাত ছেড়ে দেয়।

(১১) রামাযান সম্পর্কে জাল ও জাঈফ হাদিস: আমাদের সমাজে রামাযান সম্পর্কে অনেক জাল ও জাঈফ হাদিস প্রচলিত আছে। যেমন –
· ছিয়ামকারির নিদ্রা ইবাদত।
· তোমরা রোযা রাখ সুস্থ থাকবে।
· রামাযানের প্রথম দশ দিন রহমত, পরের দশ দিন মাগফিরাত, শেষের দশ দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি।
· রামাযান মাসের একটি ফরজ ইবাদত অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ ইবাদতের বরাবর। আর একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের একটি নফল ইবাদতের বরাবর।
· প্রত্যেক বস্তুর যাকাত আছে, আর শরীরের যাকাত হল ছিয়াম।

এছাড়া আরও অনেক বানানো, জাল ও জাঈফ হাদিস আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। যার ফলে আমরা সঠিক ইবাদত থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। পবিত্র রামাযান মাসে আল্লাহ্‌ সকলকে সঠিক বুঝ ও জ্ঞান দিন যাতে সকলে সঠিক কোরআন ও সহিহ সুন্নার উপর চলতে পারেন। আমিন।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.