259410

বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত কাঁকড়ার অনেক চাহিদা বাড়ছে 

ডেস্ক রিপোর্ট : উপযোগী পরিবেশ, ভাইরাসমুক্ত ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় দিন দিন কাঁকড়ার চাষ ও খামার বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। বিশেষ করে চিংড়িতে ভাইরাস, রপ্তানি হ্রাস এবং দাম কমে যাওয়ায় চিংড়ি চাষীরা ঝুঁকছেন কাঁকড়া চাষে। ব্যাপক চাহিদার কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকার কৃষকদের মধ্যে কাঁকড়া চাষের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশে যাচ্ছে এই কাঁকড়া। বছরে গড়ে আয় করছে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৩ লাখ মানুষের।

মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে দেশের পাঁচ উপকূলীয় এলাকায় শুরু হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ। চার প্রজাতির শিলা কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে এসব এলাকায়। এর মধ্যে রয়েছে এর মধ্যে সাইক্লা সের্রাটা, সাইক্লা, ট্রানকোবারিকা, সাইক্লা পরমামোসেইন এবং আইএসসিএল্পোলিভিসিয়া কাঁকড়া। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ৯ হাজার ৮৫৪ হেক্টর উপকূলীয় এলাকায় ১১ লাখ ৭৮৭ মে.টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছে।

জানা গেছে, মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বিশ্বে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। চিংড়ির বদলে দেশের পাঁচ উপকূলীয় জেলায় এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে কাঁকড়ার। এটি চাষে চিংড়ির মতো বেশি দামে পোনা কিনতে হয় না। প্রাকৃতিকভাবেই সাগরের লোনাপানিতে জন্মায় কাঁকড়া। জোয়ারে নদী থেকে ঘেরে পানি উঠালেই লাখ লাখ পোনা আপনাআপনিই উঠে আসে। যেসব গ্রামের শতভাগ মানুষেরই জীবিকা ছিল সুন্দরবন-কেন্দ্রিক। তা গত কয়েক বছরের ব্যবধানে কাঁকড়া চাষে সেই সব গ্রামের মানুষের জীবনচিত্র বদলে গেছে। এখন আর তাদের সংসারে কোনো অভাব নেই। আধুনিক পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ করে এ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছে। তিন-চার বছর আগে বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা আর কক্সবাজারের অনেক চিংড়ি-চাষি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আর আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির দরপতনের কারণে কাঁকড়া চাষে ঝুঁকিতে পড়েছিল। কিন্তু এখন আর সে দরপতন নেই। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতি বছর ১ লাখ ৭৮৭ মে.টন উৎপাদন হয়েছে; যার সব কাঁকড়া রপ্তানি করছে, যা দেশের অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে।

সরকারি একটি গবেষণায় বলা হয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাঁকড়ার বাজার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৯৩ সালে সনাতন পদ্ধতিতে বাংলাদেশে পুকুরে কাঁকড়ার চাষ শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে হংকংয়ে কাঁকড়া বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানির মাধ্যমে শুরু হয় অর্থনৈতিক গতিশীলতা। বর্তমানে শুধু মালয়েশিয়ায়ই প্রতি বছর ১০০ থেকে এক হাজার টন কাঁকড়া রপ্তানি হয়। এছাড়া ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশসহ মোট ১৮টি দেশের বাজারে বাংলাদেশের কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। কাঁকড়া উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। এজন্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় গবেষণা পরিচালনা করা জরুরি। দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সমস্যার সমাধান। কারণ কাঁকড়ার চাষ লাভজনক দেখে অনেক বেকার যুবক এ চাষে উৎসাহী হওয়া সত্তে¡ও অর্থনৈতিক সঙ্কট ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ছিটকে পড়ছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে উপক‚লীয় অঞ্চলের বেকার যুবকদের কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদান করা সম্ভব হবে বলে দাবি করেছে কাঁকড়া-চাষিরা।

চাষিরা বলছেন, উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সারা জাগিয়েছে। এ অঞ্চলের কৃষকের মুখে ফিরেছে হাসি। কাঁকড়া চাষে জায়গা কম লাগে, খরচও অল্প। বালাইয়ের আক্রমণ নেই বললেই চলে।

সাতক্ষীরা জেলাতে চলতি বছর ৩০৮ হেক্টর জমিতে ২৮ লাখ খাঁচায় কাঁকড়া চাষ হয়েছে। সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া ধরে খাঁচায় ছাড়া হয়। দশ-বারো দিনে খোলস পাল্টায় কাঁকড়া। চিংড়ি চাষের চেয়ে কাঁকড়া চাষে জনবল বেশি লাগায় দিন দিন এ জেলাতে কমছে বেকারত্ব। চাষিরা বলছেন, প্লাস্টিকের খাঁচায় একটি কাঁকড়া দুই-তিন সপ্তাহ পরিচর্যার পর তার খোলস পরিবর্তন করা হয়। এতে কাঁকড়ার ৮০ ভাগ ওজন বৃদ্ধি পায়। প্রকার ভেদে প্রতি কেজি কাঁকড়া ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে সাতক্ষীরায় চাষ হওয়া এসব কাঁকড়া ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। উপক‚লীয় এলাকায় কাঁকড়া চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা। গেল অর্থবছরে সাতক্ষীরায় ২৫০ হেক্টর জমিতে কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছিল ৩ হাজার ২০০ টন। চলতি অর্থবছর ৩০৮ হেক্টর জমিতে কাঁকড়ার উৎপাদন আগের বছরের চেয়ে বেশি হওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সুন্দরবন এলাকাতেও সহস্রাধিক প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ সীমানায় ১২ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। এসব কাঁকড়ার মধ্যে মাইলা, শাইলা, সিরোটা ও শীলা প্রজাতি। মাইলা ও শীলা জাতের কাঁকড়া সবচেয়ে উন্নতমানের, তাই বিদেশে এগুলোর চাহিদা বেশি। বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত কাঁকড়ার মৌসুম। বাংলাদেশ থেকে কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু সরকারিভাবে এটি এখনও রপ্তানি পণ্য হিসেবে গণ্য হয়নি। কাঁকড়া আহরণ পরিবেশের ক্ষতি করে এ যুক্তিতে সরকার ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে দেশজুড়ে কাঁকড়া আহরণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে বিদেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাঁকড়ার বাজার দখল করে নেয় ভারত, মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশের ব্যবসায়ীরা। কিছুদিন পরে কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে সরকার রপ্তানির অনুমতি দিলেও আহরণের ক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। ২০বছর ধরে রপ্তানি হতো মূলত প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কাঁকড়া। চাষিরা নদী, সাগর, ডোবা, জলাশয় থেকে কাঁকড়া আহরণ করে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে সেগুলো রাজধানীতে পাঠাতেন। রপ্তানিকারকরা সেগুলো নিজেদের মতো করে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলো শুধু চাষ করা কাঁকড়াও রপ্তানি হচ্ছে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.