206068

হেটার্সবিহীন একজন হানিফ সংকেত ও তার কিছু উপলব্ধি, যা জানা জরুরী

ডেস্ক রিপোর্ট : হানিফ সংকেত ইত্যাদি অনুষ্ঠানের বাইরে খুব একটা দেখা যায় না। তিনি কোনো টকশোতে আসেন না। খুব বেশি প্রোগ্রামে আসেন না। হুট করে ইউটিউবে খেয়াল করলাম, হানিফ সংকেতের একটা বক্তব্য। তেরো মিনিটের বক্তব্য, কিন্তু একমুহুর্তের জন্যও মনযোগ নষ্ট হলো না। কি দারুণ বাচনভঙ্গি। কি দারুণ কথার ফোয়ারা তিনি সাজিয়েছেন। এই অনুষ্ঠান থেকে কিছু বক্তব্য, কিছু শিক্ষা শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না।

হানিফ সংকেত প্রথমেই কথা বলার আদব কায়দা নিয়েই কথা বললেন। তিনি বললেন, কথা বলার আগে ভেবে নিতে হবে, কথার জের কোন পর্যন্ত যাবে। সাধক সত্যানন্দ বলেছিলেন, “অনেক কথার অনেক দোষ , ভেবেচিন্তে কথা কস”। কিন্তু আমরা ভেবেচিন্তে কথা অনেকেই বলি না। আমরা সব সময় বলি কথা কম কাজ বেশি। কিন্তু তারপর আমরাই কথা বেশি বলি, কাজ কম করি। যা বলি তা করি না, যা করি তা কিন্তু বলি না। ইদানিংকালে টকশোর জোয়ার বইছে চ্যানেলগুলোতে। একেকজনের কথা শুনলে মনে হয়, একেকজন বিশাল বুদ্ধিজীবী। এরা যেন সবজান্তা। পররাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব কীর্তি নিয়ে এদের আলাপ। আমাদের এমন বুদ্ধিজীবী হবার দরকার নেই।

রিয়েলিটি শোয়ের এই যুগে হানিফ সংকেতের ইত্যাদি চলছে ত্রিশ বছর ধরে। বছরে মাত্র ছয়বার তিনি এক ঘন্টার প্রোগ্রাম করেন। আর এই প্রোগ্রামে তিনি হাজির করেন অসাধারণ সব মানুষদের। অথচ, আজকালকার রিয়েলিটি শো’গুলোতে রিয়েল ট্যালেন্ট খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারা কিছুদিন মার্কেটে থাকেন, অনেক ফুটেজ পান, তারপর ফুটে যান। কিন্তু, হানিফ সংকেত একদম প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে কাজ করেন, যারা নিজেদের মতো নিভৃতে কাজ করে যান, সেই ট্যালেন্টেড মানুষদের তিনি ইত্যাদির মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেন।

সারাদেশের মানুষের কাছে বছরের পর বছর ধরে প্রিয় অনুষ্ঠান এই ইত্যাদি।

তার মধ্যে পলান সরকারের নাম আমরা নিতে পারি। এই মানুষটা পথে পথে গ্রামে গ্রামে হেঁটে মানুষকে বই পড়ার অভ্যাস করিয়েছেন। এখানে শিক্ষাটা হলো শুধু ফুটেজ পাওয়ার আশায় কিছু না করা এবং প্রচার নেয়ার জন্য কিছু না করা। হানিফ সংকেত মানুষের জীবনে সত্যিকার অর্থে ভ্যালু ক্রিয়েট করেছেন, যারা ভ্যালু ক্রিয়েট করে তাদেরকে সামনে এনেছেন।

পলান সরকার, বইয়ের ফেরওিয়ালা। ইত্যাদির হাত ধরেই যার পরিচয়।

টেলিভিশনে আমাদের যা দেখানো হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের যা দেখানো হয় এটাই আমাদের জগত না। এখানে যাদের মুখ বড় বড় করে আসে, এরা বাদে দেশে আর কেউ কাজ করছে না এমন না। আমাদের জগতটাকে বড় করতে হবে। তাহলে আমরা ভাল মানুষের খোঁজ পাব, ভাল কাজ করার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাব। আর প্রচার পাবার আশায় ভাল কিছু করতে হবে এমন না, আপনি দেশটার জন্য কিছু করতে চাইলে নিজের জায়গা থেকে কাজ করতে থাকুন। সময় হলে উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম আপনাকেই খুঁজে নেবে।

গ্রীন সেভার্স নামে একটি সংগঠনের কথা বলেছেন। এই সংগঠনে তিনশ ছেলেমেয়ে আছে যারা কৃষকের সন্তান এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এরা ঠিক করেছে এরা কৃষিকাজের সাথে জড়িত হবে। এদের একটি উদ্যোগ হচ্ছে নগরকৃষি। এরা ঢাকা শহরে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে বাগান করে দেয়ার কাজ করছে। এই সংগঠনের কথা কজন জানেন? হানিফ সংকেতের কথা হচ্ছে, শুধু কথার কথা না, কিছু করতে চাইলে, পরিবর্তন দেখতে চাইলে সেটা করে দেখাতে হয়। এখনকার তরুণরা চাইলে অনেক কিছু পারে, সমর্থন দিলে অনেক কিছু পারে।

একটি দুর্দান্ত কথা বলেছেন তিনি। যখন বন্যা আসে, বন্যার সাথে অনেক ময়লা চলে আসে কিন্ত ময়লা চলে যায় আর থেকে যায় পলি মাটি, আমাদের যুব সমাজ হল সেই পলি মাটি। আজকের দিনে অনেক তরুণ বিপথগামী হয়ে উঠেছে, মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু, তবুও আমাদের আশাবাদী হতে হবে। কারণ, ওই যে বন্যার সময়ে অনেক আবর্জনা আসে, কিন্তু এর মধ্যে কিছু থেকে যায়, সেই পলি মাটির মতোই আমাদের যুবসমাজদের যে অংশটি তাদের মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যাব। প্রয়োজন সঠিক গাইডলাইন।

আমাদের দেশে আত্মপ্রচারটা খুব বেশি। আমাদের দেশে মিডিয়ায় আসবার জন্য সবার হুড়োহুড়ি, কাড়াকাড়ি। মিডিয়ার মালিক যারা, তারাও কোনো না কোনো ভাবে নিজেদের দেখাতে চান। পৃথিবীর কোনো দেশের চ্যানেলের মালিকদের আমরা চিনি না। অথচ, বাংলাদেশে যাদের চ্যানেল আছে তাদের তো বটেই, তাদের আত্মীয়স্বজনদেরও আমরা চিনি প্রচারের জোয়ারে।

আপনি যদি সহী নিয়তে কোনো কিছু করতে চান, তাহলে যার উদ্দেশ্যে করছেন সে যেন আপনার ভাষাটা বোঝে এটা খেয়াল রাখতে হবে। এই প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ দিয়েছেন স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর কৃষি প্রোগ্রামের কথা। এই পোগ্রামগুলো হয় রাতের দিকে যখন কৃষক ঘুমিয়ে থাকে। আবার যোগাযোগের ঠিকানায় ইমেইল দেয়া থাকে, আরো বিবিধ জটিল বিষয়াদি। কিন্তু, কৃষকদের নিয়ে যদি কাজ করতে হয় তাহলে তারা যেভাবে বুঝবে, তাদের যেভাবে কানেক্ট করা যাবে সেভাবে কাজ করুন। এই কথা অন্য সব ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

সিস্টেম পাল্টাতে হলে সেটার অভ্যাস করতে হয়। আপনার আইন থাকলে আইন মানার অভ্যাসটা গড়ে দিতে হয়। বাংলাদেশে আইন মানুষ না জানলেও আইনের ফাঁকফোকড় কিভাবে বের করতে হয় সেটা ভাল জানে। তাহলে আইন কিভাবে মানবে মানুষ? অথচ, একই মানুষ বিদেশে গেলে একদম সোজা হয়ে যায়, রাস্তায় ময়লা ফেলে না, ট্রাফিক আইন মেনে চলে, সব নিয়মের ভেতরে। তাই হানিফ সংকেতের উপলব্ধি আইনের প্রয়োগটা জরুরি। যখন আইনের প্রয়োগ বাস্তবায়ন হবে, তখন আইন মানার অভ্যাস তৈরি হবে।

একদল অসৎ লোকের চাইতে, একজন সৎ লোক অনেক বড়। একদল অযোগ্য লোকের চাইতে একজন যোগ্য লোক অনেক প্রভাবশালী। একদল অলস লোকের চেয়ে একজন কর্মঠ লোক অনেক কাজের। আমরা বলি পানির অপর নাম জীবন, কিন্তু হানিফ সংকেত বলছেন বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। এই বিশুদ্ধতা আমাদের সব সেক্টরে প্রয়োজন, বিশুদ্ধ মানুষদের, যোগ্য মানুষদের যোগ্য জায়গায় সেট করতে পারলেই যে বদলে যাবে দেশটা..
সূত্র : এগিয়ে-চলো

পাঠকের মতামত

Comments are closed.